বিলুপ্তির পথে তাঁতশিল্প, হুমকির মুখে ব্যবসায়ীরা

তাঁত শিল্প বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ কুটির শিল্প। জাতীয় কর্মসংস্থানের দিক থেকে কৃষি ও গার্মেন্টস শিল্পের পরেই তাঁত তৃতীয় বৃহত্তম খাত। আর গ্রামীণ কর্মসংস্থানের দিক থেকে কৃষির পরে দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত। হস্তচালিত তাঁত ও পাওয়ার লুম মিলে এ খাতে বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ লোক নিয়োজিত আছেন বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়। তবে দেশের পোশাক শিল্পে এখন একটি বিলুপ্তপ্রায় শিল্পে পরিণত হয়েছে তাঁত শিল্প। অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে বাংলাদেশে তাঁতের ব্যবহার অনেক কমে গেছে। যেখানে আগে দেশের অনেক এলাকায় তাঁত বোনা হতো সেখানে বর্তমানে তাঁতির সংখ্যা নেই বললেই চলে। যাও দুই একজন আছে তারা ন্যায্য দামে কাপড় বিক্রি করতে পারে না। ফলে হুমকির মুখে রয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। দেশের বিভিন্ন জেলায় কিছুদিন আগেও তাঁতের খটখটানি আওয়াজ পাওয়া যেত। কালের বিবর্তনে এখন হারিয়ে যেতে বসেছে তাঁত কারিগরদের কর্মব্যস্ততা।

ইলেক্ট্রনিক পাওয়ার লুমের কাছে পেরে উঠছে না হ্যান্ড লুম। সংল্লিষ্টরা বলছেন, এ শিল্পের উৎপাদিত শাড়ি, লুঙ্গি, গামছাসহ নানা পণ্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি সম্ভব। তবে এ শিল্পে সুতাসহ উপকরণের ক্রমাগত মূল্য বৃদ্ধি হওয়ায় উৎপাদিত পণ্য বাজারে লোকসান দিয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে তাঁত শিল্প মালিকদের। এ কারণে অধিকাংশ তাঁত শিল্প বন্ধের দ্বারপ্রান্তে। উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় অনেক কারখানা মালিক এই শিল্পকে বন্ধ করে বিকল্প কোনো ব্যবসা বেছে নিচ্ছেন। জানা গেছে, ১৯৯০ সালে প্রথম তাঁত শুমারি পরিচালনা করে বিবিএস। ২০০৩ সালে পরিচালিত হয় দ্বিতীয় তাঁত শুমারি।

১৯৯০ সালের জরিপের প্রতিবেদনের সঙ্গে তুলনা করে জানা যায়, দেশে তাঁতের সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে। ১৯৯০ সালে দেশে তাঁতের মোট ২ লাখ ১২ হাজার ৪২১টি ইউনিট ছিল। ২০০৩ সালে এ সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫১২টি। এ হিসাবে দুই শুমারির মধ্যবর্তী সময়ে তাঁতের সংখ্যা কমেছে প্রায় ২৯ হাজার। আর তাঁত শুমারি ২০১৮ এর হিসাব অনুযায়ী, দেশজুড়ে তাঁত ইউনিটের সংখ্যা ১ লাখ ১৬ হাজার ১১৭টি । ২০১৮ সালের তাঁত শুমারির তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯০ সাল থেকেই কমছে তাঁত ইউনিট ও জনবল সংখ্যা। তাঁত ইউনিটে মাত্র ৩ লাখ ১৬ হাজার ৩১৫ জন কর্মরত ছিল শুমারির সময়ে। আর ২০০৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ৮ লাখ ৮৮ হাজার ১১৫ ও ১৯৯০ সালে ১০ লাখ ২৭ হাজার ৪০৭। এদিকে দেশের তাঁত শিল্পের জন্য সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইল জেলার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে এই দুইটি জেলাতেও তাঁতের অবস্থা শোচনীয়।

সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জের এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী হাতে-পায়ে বুনা লুঙ্গি ও গামছার জন্য বিখ্যাত তাঁতশিল্প এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। এখানকার লুঙ্গি ও গামছার সুনাম ছিল দেশের বিভিন্ন জেলায়। একসময় উপজেলার মধ্যে রায়গঞ্জ উপজেলা ছিল লুঙ্গি ও গামছার জন্য বিখ্যাত। উপজেলার প্রত্যেকটি গ্রামেই কম-বেশি লুঙ্গি ও গামছা বুনানো হতো। এমন কোনো গ্রাম নেই যেখানে দু’চারটি লুঙ্গি ও গামছা বুনানোর জন্য তাঁত ছিল না। উপজেলার গ্রামগুলোতে যারা পাঁয়ে ও হাতের সাহায্যে তাঁত বা পিৎলোম দিয়ে লুঙ্গি ও গামছা বুনাতো তারা একসময় ভালোভাবেই পরিবার নিয়ে সংসার চালাতো। কারণ সে সময় সুতার দাম কম থাকায় জমজমাট ব্যবসা করা যেতো। উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের লুঙ্গি ও গামছা সে সময় জেলার বেলকুচি, পাঁচলিয়া সহ দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকার লুঙ্গি ও গামছা কেনাবেচা হতো। এ উপজেলার তাঁতিদের বুনানো লুঙ্গি ও গামছার সুনাম আজ যেনো শুধুই স্মৃতি হয়ে আছে। সেই সময়কার তাঁতি ও ক্ষুদে ব্যবসায়ীরা আজ মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। বর্তমান বাজারে সুতার দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তাঁত পণ্যের সকল কিছুর দাম। যে দামে সুতা কিনে লুঙ্গি ও গামছা বুনে বাজারে বিক্রি করছে তা দিয়ে তাদের একেবারেই চলছে না। আবার যাদের সামর্থ আছে তারা ব্যাংক লোন কিংবা জমিজমা বিক্রি করে পাওয়ার লোম বসিয়ে ব্যবসা করছেন। অনেকে আবার বাধ্য হয়ে এ ব্যবসা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে।

অন্যদিকে টাঙ্গাইল শাড়ির প্রতি রয়েছে নারীদের অন্যরকম আকর্ষণ। সুদীর্ঘ সময় ধরে নারীদের প্রথম পছন্দ এ শাড়ির চাহিদা পূরণ করে আসছে টাঙ্গাইলের তাঁতপল্লী। জেলার বিভিন্ন এলাকায় তাঁতের শাড়ি তৈরি হলেও দেলদুয়ার উপজেলার চন্ডী-পাথরাইল ও পাশের এলাকা নিয়ে সেই তাঁতপল্লীটি। টাঙ্গাইল তাঁতশিল্প দেশের অন্যতম পুরোনো কুটির শিল্প। এ অঞ্চলের তৈরিকৃত তাঁতের শাড়ি বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। এখানকার মানুষের রুজি রোজগারের প্রধান মাধ্যম হচ্ছে এ শিল্প। সুঁতো কাটা থেকে তানা সাজানো, শাড়ি বানানো থেকে শাড়ি বিক্রি পর্যন্ত সম্পৃক্ত তাঁত পল্লীর অধিকাংশ মানুষ। শাড়ির বাজারের সাথে ঘুরে এখানকার সাধারণ মানুষের ভাগ্যের চাকা। অথচ এখন সংকটে টাঙ্গাইলের তাঁত শিল্পও।

দফায় দফায় সুঁতার দাম বৃদ্ধি, বিভিন্ন মহামারিসহ কারিগরের অভাবে এ শিল্প হুমকির মুখে। তাঁত বোর্ডের তথ্য মতে, জেলায় তাঁতের সংখ্যা কমে হয়েছে ৩৪ হাজার ৪০২টি। তাঁত মালিকের সংখ্যা রয়েছে ৪ হাজার ১৫১ জন। এ তাঁতপল্লীতে কেউ শাড়ি বুনেন, কেউ চরকায় সুঁতা কাটেন, কেউ কাপড়ের নকশার সুঁতা কাটেন। আবার সুঁতা রঙ করা, শুকানো, পাটিকরা, তানার সুঁতা কাটা, ড্রাম থেকে ভিমে সুতা পেঁচানো, তানা সাজানো, মালা বা নকশার ডিজাইন তোলা, কাপড় ভাঁজ করা, পেটি করা এবং বাজারজাত ও আনা-নেওয়ার কাজ করে থাকে এ পেশায় সম্পৃক্তরা। পেশাটি নিয়ে তৃণমূলে সম্পৃক্তরা উদ্বিগ্ন। স্থানীয় অধিকাংশ তাঁতীরা ইতোমধ্যে পেশা পরিবর্তন করেছে। তাঁত কারখানার শ্রমিকরা বলছেন, অন্য কোনো কাজ না জানার কারণে তারা বাধ্য হয়েই তাঁত কারখানায় কাজ করেন। মালিকরা ক্ষতির মুখে থাকার কারণে নিয়মিত মজুরি দিতে পারছে না। ফলে ছেলে-মেয়ে নিয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে তাদের। অন্যদিকে তাঁত মালিকরা জানান, সুতাসহ উপকরণের মূল্য নির্ধারণ করে এবং স্বল্প সুদে ঋণ দিলে এ শিল্প সচল করা সম্ভব হবে। সুতাসহ উৎপাদনের উপকরণের দাম নির্ধারণ করে ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকার সহযোগিতা না করলে অচিরেই এই শিল্প বিলুপ্ত হয়ে যাবে।