অনিয়ন্ত্রিত বেকারি পণ্য বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

সাধারণ মানুষ এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি পথখাবার খেয়ে থাকে। যার মধ্যে বেকারিতে তৈরি খাবারই বেশি। কিন্তু নিম্নমানের উপকরণ, পোড়া ও বাসি তেল, বিষাক্ত টেক্সটাইল রং ও রাসায়নিক ব্যবহার করে তৈরি করা হয় কেক, পাউরুটি, বনরুটি, চানাচুরসহ বিভিন্ন খাদ্য। এসব খাবার স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করলে কয়েকদিন পরিবেশ একটু ভালো রাখলেও সারা বছরই একই অবস্থায় চলে বেকারিগুলো। অধিকাংশ বেকারিতে দেখা যায়, মেঝে পাকা করা নেই। বেশির ভাগ কারখানায় কর্মচারীরা হাতে গ্লাভস পরা ছাড়াই ময়দা পিষছেন। অনেককে দেখা যায়, খালি গায়ে আটা-ময়দার স্তূপে দাঁড়িয়ে ময়দা মাখতে। কারও শরীর থেকে ঘাম ঝরছে। কেউ এক হাতে সিগারেট ফুঁকছেন, অন্য হাত দিয়ে কাজ করছেন। খোলা তেলভর্তি ড্রামের ওপর দেখা যায়, মাছি ভনভন করছে। অধিকাংশ কারাখানায় দেখা যায় যেখানে-সেখানে ইঁদুর ও তেলাপোকার বিষ্ঠা ছড়িয়ে আছে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এসব পণ্যই বাহারি মোড়কে বাজারজাত করা হচ্ছে। পণ্যের প্যাকেটে বিএসটিআই সিল ও লাইসেন্স নম্বর দেওয়া থাকলেও, অধিকাংশ বেকারিতে এগুলোর প্রমাণপত্র নেই। এ সব পণ্য খোলা বাজারে খুচরা ও পাইকারি বিক্রি হচ্ছে। অধিকাংশ ক্রেতাই জানেন না, কেমন পরিবেশে তৈরি খাবার কিনছেন। বিক্রেতারা বলছেন, তাঁরা বেকারি থেকে কিনছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁরাও জানেন না এসব খাবার মানবদেহের জন্য কতটুকু ক্ষতিকর। তবে সচেতন ক্রেতারা বলছেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদারকির অভাবে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে বেকারিগুলো। এতে অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে তৈরি খাবার যেমন জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে, তেমনি সরকারও রাজস্ব হারাচ্ছে ।

এসব নিয়ন্ত্রণের জন্য ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও বিএসটিআই বা প্রশাসনের তেমন উদ্যোগ চোখে পড়ে না বলেও অভিযোগ তাদের। এদিকে বেকারিতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা বিএসটিআই ও বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, দেশের বেশিরভাগ বেকারি প্রচলিত নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করছে না। এর মধ্যে ছোট ছোট হস্তচালিত বেকারিগুলোর নিয়ম ভঙ্গের প্রবণতা খুব বেশি। অধিকাংশ ভ্রাম্যমাণ আদালতে তাদের জরিমানা হচ্ছে। তারা বলছেন, বেশিভাগ ক্ষেত্রে বেকারিগুলোতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ পাওয়া যাচ্ছে।

এ ছাড়া নিম্নমানের খাবার তৈরি বেকারিগুলোর একটি বড় সমস্য। তারা এ-ও বলছেন, পাড়া-মহল্লার অধিকাংশ বেকারি অনুমোদন না নিয়েই বিএসটিআইয়ের মানচিহ্ন ব্যবহার করে পণ্য বিক্রি করছে। আবার কারও কারও অনুমোদন থাকলেও সেটি হালনাগাদ নয়। পাশাপাশি তারা পণ্য মোড়কজাতকরণ নিবন্ধন সনদ নেয় না। পণ্যের গায়ে থাকে না উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও মেয়াদোত্তীর্ণের সঠিক তারিখ। বেকারিগুলো তাদের শ্রমিক, কর্মী ও কারখানার পরিচচ্ছন্নতা বিষয়ে একেবারে উদাসীন। খাবারে পোকামাকড়ের উপস্থিতি, উৎপাদিত পণ্য যত্রতত্র সংরক্ষণ, নিম্নমানের উপাদান-উপকরণ ব্যবহার করা, ফুড গ্রেডেড নয় এমন কালার ও ফ্লেভার ব্যবহার বেকারিগুলোর জন্য নিত্যনৈমিত্তিক অপরাধ। জানা যায়, দেশে দুই ধরনের বেকারি রয়েছে। একটি হস্তচালিত (হাতে তৈরি নন-ব্র্যান্ড) বেকারি। দেশে ছোট-বড় পাঁচ হাজার এমন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যারা হাতে তৈরি পণ্য দেশের পাড়া-মহল্লায় বিক্রি করেন। অন্য ধরনটি অটো ও সেমি-অটো বেকারি। দেশে ১০০টির মতো এ ধরনের বেকারি রয়েছে, যা স্বয়ংক্রিয় কারখানায় পণ্য তৈরি করছে। এদের মধ্যে ৫০টি মাঝারি আকৃতির, ৩৫টির মতো কারখানা বড়। এ ছাড়া দেশের বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী আরও প্রায় ১৫টি কারখানা করেছে। যেগুলো এখন বেকারি ব্র্যান্ড। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বয়ংক্রিয় কারখানায় পণ্য যারা তৈরি করছেন তাদের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সমস্যা পাওয়া যাচ্ছে না। তবে হাতে তৈরি বেকারিগুলোর উন্নতি হচ্ছে খুব ধীরে। এখনো কিছু বেকারিতে পা দিয়ে খামির তৈরির মতো ঘটনা হচ্ছে, যদিও সেটা আগের তুলনায় কম। এসব বিষয়ে হাতে তৈরি বেকারি পণ্য উৎপাদনকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ রুটি, বিস্কুট ও কনফেকশনারি প্রস্তুতকারক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. রেজাউল হক বলেন, শুরু থেকে কিছু সমস্যা বেকারিতে ছিল। তবে এখন সেসব কাটিয়ে উঠছে। যারা ভালোভাবে নিয়ম-নীতি মেনে ব্যবসা পরিচালনা করছেন, তারাই টিকে থাকতে পারছে। সরকারের নানা সংস্থা এখন তদারকি করছে। এতে অবস্থা অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। এদিকে, বেকারি পণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে ক্ষতিকর রাসায়নিক। জানা যায়, পাউরুটি ফোলানো, কৃত্রিম রং ও বিভিন্ন আকৃতি দিতে ট্রান্সফ্যাট ও মিষ্টিজাতীয় রাসায়নিক সোডিয়াম সাইক্রোমেট নামের উপাদান ব্যবহার করা হয়। বেশ কয়েক বছর ধরে পটাশিয়াম ব্রোমেট ও পটাশিয়াম আয়োডিনও ব্যবহার করা হচ্ছে। বেকারি শিল্পের লোকজনের কাছে এটি ‘ব্রেড এনহ্যান্সার’ নামে পরিচিত। সোডিয়াম সাইক্রোমেটের তুলনায় পটাশিয়াম কম দাম হওয়ায় খরচ বাঁচাতে এটা করা হচ্ছে।

এ ছাড়া খাবার মুচমুচে ও সুস্বাদু করার জন্য ব্যবহার হয় সাল্টু বা অ্যামোনিয়াম। বেকারি সূত্রে জানা যায়, একসময় পাউরুটি ফোলাতে ও দীর্ঘসময় খামির সতেজ রাখতে খাবার সোডা ব্যবহার করা হতো। এখন পটাশিয়াম ব্যবহার হয়। এ ছাড়া সাল্টু এর স্বাদ বাড়ায়। কম দাম বলে এসব বেকারি মালিকদের খরচও কমায়। তবে এসব রাসায়নিক জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হলেও সে বিষয়ে ভ্রুক্ষেপ করে না মালিকরা।

বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পরিচালক (খাদ্য পরীক্ষাগার নেটওয়ার্ক সমন্বয়) ড. সহদেব চন্দ্র সাহা বলেন, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত রুটি, পাউরুটি ও বেকারি খাদ্যে ক্ষতিকর অ্যামোনিয়াম সালফেট, পটাশিয়াম ব্রোমেট ও পটাশিয়াম আয়োডিন ব্যবহার করা হচ্ছে এটা সত্য, যা একটি বড় সমস্যা। খাদ্যে এসব বিষাক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার থাইরয়েড গ্রন্থির রোগ, ক্যানসার, জিনগত রোগ ও মিউটেশন, ডায়রিয়া, বমিভাব ও পেটের পীড়া তৈরি করতে পারে। অনেক বেকারিতে ব্রেড ইমপ্রুভার এনজাইম নামে কিছু উপাদান কয়েক বছর ধরে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর সঙ্গে রাসায়নিকও ব্যবহার হচ্ছে। যেগুলো কোনটি ক্ষতিকর ও কোনটি ভালো সেটা অধিকাংশের জানা নেই। সচেতন নাগরিকেরা বলছেন, বেকারিগুলোতে তৈরি পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। সেই সঙ্গে খোলা বাজার থেকে খাদ্যদ্রব্য কেনার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের সতর্ক থাকা দরকার।