শোষিতের পক্ষে আজন্ম সংগ্রামী কমরেড জসীম মন্ডল, লাল সালাম

রবিউল ইসলাম রবি

সাধারণ খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ে নীতি আদর্শে অটল থেকে আমৃত্যু সংগ্রাম করে যাওয়া এক বিপ্লবী কমরেড জসীম উদ্দিন মন্ডল। নিজেকে পরিচয় দিতেন গরীব পার্টির নেতা বলে। সমাজতন্ত্রের দীক্ষায় বৈষম্যহীন সমাজ করার স্বপ্নে তিনি পথ চলেছেন। শত সহস্র প্রতিকূলতার মুখেও তিনি শোষকের কাছে নিপীড়িত সাধারণ মানুষের বঞ্চনার সমাজ ব্যবস্থাকে ভেঙে সাম্যের সমাজ গড়ার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। আজীবন দৃঢ় কন্ঠে বলেছেন, এ সমাজ পঁচা গলা সমাজ, এ সমাজ ভাঙিতেই হইবে।
জসীম উদ্দিন মন্ডল একজন বামপন্থী বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা, প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা। তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।
১৯২২ সালে অবিভক্ত ভারতের নদীয়া জেলার কালিদাসপুর গ্রামে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। যুব বয়সে ১৯৩৯ সালে তিনি রেল ইঞ্জিনে কয়লা ফেলার শ্রমিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এ থেকে শ্রমিক শোষণের চিত্র দেখে তিনি প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। একদিকে দারিদ্রতা অন্যদিকে অত্যাচার তাকে বিৃটিশ রেল কোম্পানীর বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করে, তিনি হয়ে ওঠেন জীবনের রেলগাড়ির অগ্রযাত্রার প্রতিক।
কিশোর বয়সেই জসিম মন্ডল দেখা পেয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধীর। তখন তিনি জানলেন অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেওয়া ব্যক্তিদের কথা। ১৯৪২ এর আগস্ট শুরু হয় ঐতিহাসিক ভারত ছাড় আন্দোলন বৃটিশদের বিরুদ্ধে। চাকুরি করা তখন বেশ কঠিন ছিল। মাসে ১৭ টাকা বেতনে সহকারি ফায়ারম্যান হিসেবে চাকুরি করতে হতো। পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, শ্রমিক এলাকায় সক্রিয়ভাবে আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং একজন সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। অনেকবার তিনি কারাভোগ করেছেন। তিনি শ্রমিক-জনসভাগুলোতে সাধারন ভাষায় সুন্দরভাবে বক্তব্য দিতে পারতেন বলে তার সমাবেশগুলোতে অগণিত মানুষ উপস্থিত হতো কেবল তার বক্তব্য শোনার জন্য।
কমরেড জসিম মণ্ডল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সৈনিক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তার কাঁধে লেখা ছিল ‘আইই (ইন্ডিয়ান ইঞ্জিনিয়ার্স)’। মুম্বাই, মাদ্রাজসহ বিভিন্ন বন্দর থেকে যেসব কামান, বারুদের গাড়ি আসত, সেগুলো ট্রেনে আসামে পৌঁছে দিতেন। ট্রেনের ইঞ্জিনের বয়লারে কয়লা ভরতেন। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত যুদ্ধে নানাবিধ সাহায্য করেছেন।
ছেচল্লিশের দাঙ্গায় জসিম মণ্ডল বীরোচিত ভূমিকা পালন করেন। শিয়ালদহ থেকে রানাঘাটের উদ্দেশে ট্রেন ছেড়েছিল। প্রায় ৫০০ জন দাঙ্গাবাজ ট্রেন লাইনের উপর লাল কাপড় নিয়ে দাড়িয়ে ছিল, যাতে ট্রেন থামে এবং ট্রেনের যাত্রীরা দাঙ্গার শিকার হয়। সে সময় কমরেড জসিম এক অসম সাহসিকতার কাজ করেন। তিনি ট্রেনের চালককে বলেন; ট্রেনে যাত্রী ৫০০০ জন, পক্ষান্তরে দাঙাবাজ ৫০০ জন, পাচঁহাজার যাত্রীকে বাচাঁনোর জন্য ওই দাঙ্গাবাজদের উপরেই ট্রেন চালিয়ে দিতে হবে। কথামত ট্রেনচালক সেই কাজ করেন। কতজন দাঙ্গাবাজ মারা গিয়েছিল তার সঠিক পরিসংখ্যান কেউ করেনি। তবে কমরেড জসিমের দৃঢ় চিত্তের কারণে বেচেঁ গিয়েছিল প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের প্রাণ।
কমরেড জসিম ও তার পরিবার প্রথম থেকেই পাকিস্তানের জন্মই স্বীকার করেননি। একাত্তরে ভারতে থাকা অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা রাখেন জসিম মণ্ডল। জসিমের স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, অর্থাৎ পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের সবাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। রাজাকারদের দেওয়া সেই তথ্যের ভিত্তিতে তাই যুদ্ধের সময় পুরো ঈশ্বরদীতে কোনো বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা না হলেও; প্রচণ্ড হিংসাবশত তার বাড়ি পুড়িয়ে খুঁটি পর্যন্ত তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরে সেই জমি বিক্রি করে তারা খেয়েছেন। তারা; কুষ্টিয়া-পাবনা সেক্টরে গেরিলা বাহিনীতে কুষ্টিয়ার কমিউনিস্ট জাহিদ রুমীর অধীনে যুদ্ধ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় গোটা ভারতের অর্ধেক চষেছিলেন তিনি। ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, রণেশ মিত্র, ইলা মিত্রের কাজই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অর্গানাইজ করা। কে কোথায় ট্রেনিং নিয়ে এসেছে, ক্যাম্পে জায়গা হচ্ছে কি না সব দেখাশোনা করা। এই বিপ্লবী মানুষটার দুই মেয়েকে জ্যোতি বসু মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে কাজ দিয়েছিলেন।
জসীম মন্ডলের সাথে আমার পরিচয় খুব ছোট বয়সে। একেবারে শিশুকালে। আমার জন্মেরও আগে আমার পরিবারের সাথে তাঁর ছিলো গভীর আত্মীয়তার বন্ধন। তাঁকে আমি চিনতাম আমার দুলাভাই হিসেবে।
মায়ের মুখে শোনা গল্পে জেনেছি, ১৯৪৭ – ৪৮ সালের দিকে কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতিতে যুক্ত থাকায় কমরেড জসীম মন্ডল ও আমার বড়ভাই প্রয়াত আমিনুল ইসলাম বাদশাকে আটক করে জেলে নেয় তৎকালীন সরকার। আমার বাবা মরহুম নুরুজ্জামান শেখ তখন ঈশ^রদীতে চাকুরী করতেন। তিনি সে সময় খেয়াল করে দেখেন, একজন নারী প্রায় প্রতিদিনই বাসে চড়ে ঈশ^রদী থেকে পাবনা আসেন। তৎকালীন সময়ে মেয়েদের বাইরে খুব বেশী একাকী চলাচল ছিলো না। বিষয়টি লক্ষ্য করে কৌতুহলবশত সেই নারীকে জিজ্ঞেস করেন, মা তুমি রোজ কোথায় যাও? নাম পরিচয়, ইত্যাদি। উত্তরে ঐ নারী জানান, তার নাম জাহানারা, স্বামী কমরেড জসীম উদ্দিন মন্ডল পাবনা জেলে আটক। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিতেই তাঁকে প্রতিদিন পাবনা যেতে হয়।
জাহানারা নামটি শুনেই বাবা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। কারণ জাহানারা নামে আমার একটি বোন শৈশবেই মারা যান। দুলাভাই জসীম মন্ডল ও বড়ভাই আমিনুল ইসলাম বাদশা একই দল করে সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ে জেলবন্দী। বাবা তখনই জাহানারা বুবুকে নিজের মেয়ে হিসেবে মা বলে ডাকেন। কেবল ডাক নয়, নিজের মেয়ের মর্যাদায় আমাদের বাড়িতেও তাঁকে নিয়ে আসেন। সেই থেকে তিনি আমাদের পরিবারে জাহানারা বুবু। আর জসীম ভাই হয়ে গেলেন দুলাভাই। বড় ভাই আমিনুল ইসলাম বাদশার সাথে তার নিবিড় সম্পর্ক ছিলো রাজনৈতিক আদর্শের। পরে, সে সম্পর্ক রূপ নেই শ্যালক দুলাভাইয়ের।
কারামুক্তির পর বড়ভাই আমিনুল ইসলাম বাদশার সাথে জসীম দুলাভাই ও জাহানারা বুবুকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসলেন বাবা। মা নিজের বড় জামাইয়ের মর্যাদায় তাকে আপ্যায়ন করলেন। জাহানারা বুবু, দুলাভাই মা বাবার মতোই আমার বাবা মা কে সম্মানের আসনে স্থান দিলেন। আমাদের বাড়িতে নাইয়রেও আসতেন তারা।
আমৃত্য জসীম ভাই আমাকে নিজের শ্যালকের মতো আদর স্নেহ শাসন করেছেন। আবদার দুষ্টুমি কিছুই বাদ ছিলোনা সে সম্পর্কে।
কিশোর বয়স থেকে জসিম উদ্দিন মণ্ডল ভারতের মহাত্মা গান্ধী, বাঘাজতীন, প্রীতিলতা, জ্যোতি বসু, কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য, বিদ্রোহী কাজী নজরুল ইসলামসহ প্রখ্যাত মানুষের সান্নিধ্য পান। ষাটের দশকে রেলওয়েতে চালের বদলে খুদ দেওয়ায় তিনি রেল শ্রমিকদের নিয়ে প্রতিবাদ ও আন্দোলন করেন। এতে তাঁর চাকরি চলে যায়। তিনি শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। আন্দোলন করতে গিয়ে একাধিকবার কারাবরণ ও ব্রিটিশ সরকারের নির্যাতনের শিকার হন। আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে তিনি মোট ১৯ বছর কারাভোগ করেন।

জসিম উদ্দিন মণ্ডলের নিজস্ব কোনো বাড়ি নেই। বন্দোবস্ত নেওয়া সরকারি এক খণ্ড জায়গায় তিনি বসবাস করতেন। বাড়ির পাশেই নিজ উদ্যোগে ১৯৯৬ সালে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে তোলেন। পরবর্তী সময় বিদ্যালয়টি সরকারীকরণ হয়। বিদ্যালয়ের নাম পশ্চিম টেংরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
২০১৭ সালে ২রা অক্টোবর তাঁর মৃত্যুর পর কেটে গেলো ৫ বছর। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টির নাম বিপ্লবী জসীম মন্ডলের নামে নামকরণ করার দাবি জানাই। বাঙালি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদানের বিপরীতে এই দাবিটি খুব সামান্য বলেই আমি মনে করি।
শেষ করবো, জসীম ভাইয়ের মুখে শোনা, তাঁর বিশ^াস করা কয়েকটি লাইন দিয়ে।
“ ‘দরখাস্ত করে, হুজুরের পানিপড়া দিয়ে, স্লোগান দিয়ে এই সমাজ একচুলও পরিবর্তন করা যাবে না। সমাজতন্ত্র ছাড়া কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে না। এই সমাজ বড়লোকের সমাজ, শ্রমশোষণের সমাজ, এই সমাজ ভাঙ্গিতে হবে এবং ভাঙ্গিতেই হবে।”
জসীম মন্ডলের দৈহিক অনুপস্থিতি থাকলেও, তিনি হারিয়ে যাননি। তার বলে যাওয়া প্রতিটি শব্দ আজ অনেক বেশী প্রাসঙ্গিক।
বৈষ্যম্যের সমাজ ভেঙে সাধারণের অধিকার নিশ্চয়ই একদিন প্রতিষ্ঠা পাবে। জসীম মন্ডলদের স্বপ্ন পূরণে সমাজে সাম্য আসুক। জয় হোক মেহনতি মানুষের।

লেখক, মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক সভাপতি পাবনা প্রেসক্লাব।