মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারে মাটি ক্ষতিগ্রস্ত এবং কৃষকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে

পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলায় ২৬ বছর ধরে শিমের বাণিজ্যিক আবাদ হয়। এ উপজেলার মুলাডুলি ইউনিয়নের বেতবাড়িয়া, ফরিদপুর, আটঘরিয়া, বাঘহাছলা ও শেখপাড়া গ্রামে সবচেয়ে বেশি শিমের চাষ হয়। এখানকার ৯০ ভাগ জমিতেই কৃষকরা শিমচাষ করেন। তবে শিমের মৌসুম এলেই এখানকার গ্রামের বাতাসে ভেসে বেড়ায় কীটনাশকের গন্ধ। প্রতি বিঘা জমিতে কৃষকরা শিম আবাদে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকার কীটনাশক ব্যবহার করেন। যা অন্য কোনো আবাদে হয় না।

মুলাডুলি ইউনিয়নের বেতবাড়িয়া, মুলাডুলি, শেখপাড়া, বাঘহাছলা, আটঘরিয়া, ফরিদপুর গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি গ্রামের বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে শুধু শিমের আবাদ। চাষিরা শিম গাছের পরিচর্যা করছেন। কেউ শিম তুলছেন কেউবা আগাছা পরিষ্কার করছেন। আবার অনেকে শিমের ক্ষেতে কীটনাশক স্প্রে করছেন। কীটনাশক ব্যবহারের পর ওই এলাকায় বিষের উৎকট গন্ধে পথ চলতে নাকে রুমাল দিতে হচ্ছে।

ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এ উপজেলায় গত বছর শিমের আবাদ হয় ১১৩০ হেক্টর জমিতে। এবার শিমের আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়েছে ১২০০ হেক্টর জমি। এরমধ্যে মুলাডুলি ইউনিয়নেই ৮৫০ হেক্টর জমিতে শিম চাষ হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিমের আবাদে দুই ধরনের কীটনাশক বেশি ব্যবহার হয়। একটি পোকামাকড় দমনে অপরটি ছত্রাকনাশক বা পঁচনরোধে ব্যবহার হয়। এছাড়াও ফলন বৃদ্ধির জন্য গাছের উপরে কমপ্লেসাল সুপার, মিরাকোলান জাতীয় কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। যা স্থানীয় কৃষকদের কাছে শিম গাছের ভিটামিন নামে পরিচিত।

শিমের ফুল ও কচি শিমের জাবপোকা দমন করতে সপ্তাহের পাঁচ দিন কীটনাশক স্প্রে করতে হয়। কোনো কোনো জমিতে পোকার আক্রমণ বেশি হওয়ায় দিনে দুইবারও বিষ প্রয়োগ করেন কৃষকরা। কৃষকরা সাধারণত ছত্রাকনাশক হিসেবে সানকোনাজল, ফলিপুর, কনটাফ, লোনা, অটোস্টিন, এনট্রাকল এবং পোকাদমনে ফেনফেন, সুমি আলফা, বেল্ড এক্সপার্ট, এরাস্টার, এমাপ্লাস, লুমেকিটিন, কনফিডর ও সলেমনসহ বিভিন্ন নামে কীটনাশক ব্যবহার করেন।

শিম আবাদে প্রতি বিঘায় কমপক্ষে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকার কীটনাশক ব্যবহার হয়। কখনো কখনো আরও বেশি হয়। ঈশ্বরদীতে ১২শো হেক্টর জমিতে শিমের আবাদ হয়। অর্থাৎ ৯ হাজার বিঘা। সেই হিসাবে বিঘা প্রতি যদি কীটনাশক খরচ ৮ হাজার ধরা হয় তাহলে ৯ হাজার বিঘা শিমের জমিতে ৭ কোটি ২০ হাজার টাকার কীটনাশক ব্যবহার হয়।

মুলাডুলি গ্রামের কৃষক নবীর উদ্দিন বলেন, শিম আবাদে এখন সবচেয়ে বেশি খরচ হয় কীটনাশকে। কীটনাশকের একদিকে ব্যবহার বেড়েছে অন্যদিকে দামও বেড়েছে। প্রতিবিঘা শিমের জমিতে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকার কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। আবার কখনো কখনো এরচেয়েও বেশি খরচ হয়।

বেতবাড়িয়া গ্রামের কৃষক আব্দুর রহিম বলেন, এ গ্রামের ৯৫ ভাগ জমিতে শিমের আবাদ হয়েছে। শিমের গাছ বড় হওয়ার পর পঁচনরোধ ও পোকাদমনে দুই-তিন দিন পরপরই বিষ (কীটনাশক) দিতে হয়। ফসলে কীটনাশক ব্যবহার করলে দুর্গন্ধ ছড়ায় ও পরিবেশ নষ্ট হয়, কিন্তু কিছু করার নেই। শিম চাষ করতে হলে কীটনাশক ব্যবহার করতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই বলেও জানান এই কৃষক।

শিমচাষে সুখ্যাতির জন্য শিম বাবু হিসেবে পরিচিত মুলাডুলি গ্রামের আমিনুল ইসলাম বাবু। তিনি বলেন, এক বিঘা জমিতে শিমের কীটনাশক বাবদ খরচ করতে হয় ১০-১২ হাজার টাকা। দানাদার, সুমিথিয়ন, টাফগড়, ফ্যানথেন, ওকোজিমসহ নানা ধরনের কীটনাশক নিয়মিত জমিতে স্প্রে করতে হয়। মাঝে মধ্যে অসাবধানতাবসত শরীরে পড়লে কৃষকরা অসুস্থ হয়ে পড়েন, এমনকি জ্ঞানও হারিয়ে ফেলেন।

মুলাডুলি বাজারের সার ও কীটনাশক ব্যবসায়ী আল-আমিন ট্রেডার্সের সত্ত্বাধিকারী আরিফুল ইসলাম বলেন, আমাদের এলাকায় আগাম শিমসহ ৭-৮ মাস শিমের আবাদ হয়। আবহাওয়া অনুকূলে না থাকলে কীটনাশকের বেশি প্রয়োজন হয়। এক বিঘা জমিতে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকার কীটনাশক ব্যবহার হয়। শিম মৌসুমে সবচেয়ে বেশি কীটনাশকের ব্যবহার হয়।

মুলাডুলি ইউনিয়নের উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা রুমানা ইয়াসমিন বলেন, আমরা মাঠ পর্যায়ে পর্যালোচনা করে দেখেছি এক বিঘা জমিতে শিম আবাদে ৩৯ হাজার টাকা খরচ হয়। এরমধ্যে কীটনাশক বাবদ ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা খরচ হয়। আবহাওয়া অনুকূলে না থাকলে শিমচাষে কীটনাশক বেশি প্রয়োজন হয়। শীতকালে রোদের উত্তাপ বেশি থাকলে শিমে পোকামাকড়ের আক্রমণ বেড়ে যায়। তখন বেশি কীটনাশকের প্রয়োজন হয়। এখন পরিবেশ বান্ধব বেশ কিছু কীটনাশক বাজারে এসেছে। আমরা কৃষকদের পরিবেশ বান্ধব কীটনাশক প্রয়োগের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। যাতে পরিবেশ বিপর্যয় না ঘটে। তিনি আরও বলেন, মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারে মাটি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং কৃষকদের স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়ছে। এ ব্যাপারে কৃষকদের বারবার বোঝানো হলেও তারা মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছেন।

ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. শফিকুল ইসলাম শামীম বলেন, সবজি আবাদে কীটনাশকের ব্যবহার মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। কীটনাশক ব্যবহারে উৎপাদিত সবজি স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এসব সবজি খেলে ক্যানসারও হতে পারে। কিডনি ও লিভার ড্যামেজ, বিকলাঙ্গ শিশুর জন্মসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে মানুষ।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মিতা সরকার বলেন, ঈশ্বরদী উপজেলার ১২শো হেক্টর জমিতে শিমের চাষ হয়। ফসল উৎপাদনে কীটনাশক যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক। আমরা সবসময় নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহারের জন্য কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে থাকি। রাসায়নিক কীটনাশকের পাশাপাশি জৈব কীটনাশক ব্যবহারেও উৎসাহিত করছি। জৈব কীটনাশকে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। পরিবেশ ভালো থাকবে এবং কৃষক ও ভোক্তাদের স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি হবে না। মাঠ দিবস ও প্রদর্শনীতে জৈব সারের ব্যবহার সম্পর্কে কৃষককে সচেতন করা হচ্ছে।