পাবনার মেঠোপথে বঙ্গকন্যা | আশেক মাহমুদ সোহান

বঙ্গবন্ধু যেমন পাবনার মানুষকে ভালবেসে তাঁর জীবদ্দশায় বহুবার পাবনা এসেছেন, তেমনি তাঁর সুযোগ্য কন্যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বেশ কয়েকবার পাবনা এসেছেন। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে আন্দোলন সংগ্রামে পাবনার মানুষকে একত্রিত করতে বঙ্গবন্ধু এসেছেন আওয়ামী লীগ গঠন,যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬ দফাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে, আবার স্বাধীনতা পরবর্তী দেশ পুনর্গঠনের একদম প্রাথমিক পর্যায়ে ১৯৭২ সালেই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাবনার উন্নয়নে মুজিব বাঁধ সহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রম উদ্বোধনে আসেন। বঙ্গবন্ধু কন্যাও তেমনি পাবনায় বারবার এসেছেন পাবনাবাসীর জন্য নানা উপহার নিয়ে। প্রাচীন শতবর্ষী এই জেলার ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে কারণ শেখ হাসিনা যেভাবে একাধারে রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, জেলায় শতভাগ বিদ্যুতায়ন, সড়ক যোগাযোগের অভূতপূর্ব উন্নয়ন, পাবনা মেডিকেল কলেজকে পূর্ণাঙ্গ হাসপাতালে রুপান্তরের মতো কার্যক্রম করে দেখিয়েছেন তা পূর্বে কেউ পাবনাবাসীর জন্য করেনি। তবে পাবনার বর্ণাঢ্য ইতিহাসে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ইতিহাসটা তিনি রচনা করেছেন পাবনার রাজপথ কাঁপানো সাবেক ছাত্রনেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সাহাবুদ্দিন চুপপু’কে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ২২ তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত করার মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধু যে আত্মিক বন্ধনে পাবনার মানুষের সাথে জড়িয়েছিলেন, তাঁর কন্যা শেখ হাসিনাও পাবনার মানুষকে সেভাবেই ভালোবেসেছেন। তারই চূড়ান্ত রুপ আজকের এই সমৃদ্ধ পাবনা জেলা।

তবে শুধু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, ৭৫ এর পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দলীয় প্রধান হিসেবে তিনি যখন দায়িত্ব গ্রহণ করেন,দেশে ফিরেই দলের ভঙ্গুরতা কাটাতে তিনি পাবনা সফর করেন। তার আগমনী বার্তা শুনে লক্ষ লক্ষ মানুষ নগরবাড়ি-পাবনা মহাসড়কে তাকে এক পলক দেখার জন্য ছুটে যায়। তাকে পুষ্পবৃষ্টিতে পাবনার আপামর জনতা বরণ করে নেয়।

১৯৮১ থেকে ১৯৯১ দেশের রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন ও নানা জনমুখী কার্যক্রমের নেতৃত্ব দিয়ে এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে সারা বাংলাদেশে সুসংগঠিত করার মাধ্যমে নিজেকে পিতার যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে প্রমাণ করেন। এই সময়ে তিনি কয়েকবার পাবনা এসেছেন এবং উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জনসভায় ও সাংগঠনিক কর্মকান্ডে যাওয়ার উদ্দেশ্যে তৎকালীন উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বারখ্যাত পাবনার নগরবাড়ি ঘাট দিয়ে চলতিপথে পাবনার মানুষের সাথে কুশলাদি বিনিময় করতেন।

তবে পাবনার ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কময় ঘটনা ঘটে,যেদিন স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করে,১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনা পাবনা আসেন ঈশ্বরদী ট্রেন মার্চে; ঐদিন বঙ্গবন্ধু কন্যার ট্রেনের বগি লক্ষ্য করে তারা গুলি ছুঁড়ে। অল্পের জন্য তিনি প্রাণে বেঁচে যান।

এরপর ১৯৯৮ সালে বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহচর,মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক পাবনা ২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আহমেদ তফিজ উদ্দিনের মৃত্যুর পর তার চল্লিশায় সুজানগরের সাতবাড়িয়ায় তার বাড়িতে আসেন শোকসন্তপ্ত পরিবারের সবাইকে সমবেদনা জানাতে এবং স্মরণসভায় বক্তৃতা করেন।

১৯৯৯ সালেও তিনি পাবনায় এসেছিলেন, ৬ই মার্চ পাবনার ঐতিহ্যবাহী সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের শতবর্ষী উদযাপন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে আসন অলংকৃত করেন এবং সেই অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ পাবনার উন্নয়নে জনগণের সকল প্রত্যাশা পূরণের প্রতিশ্রুতি দেন। তারই ফলশ্রুতিতে ২০০১ সালে সংসদে ‘পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন’ পাস হয় এবং ঐ বছরের ১৩ই জানুয়ারি পাবনার কর্মজীবী মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার প্রয়াসে ঈশ্বরদী ইপিজেড উদ্বোধন করেন,যা ছিল তৎকালীন সময়ে পাবনার মানুষের জন্য আশীর্বাদস্বরুপ। ঐদিনই তিনি দক্ষিণাঞ্চলের সাথে পাবনা তথা সমগ্র বাংলাদেশের যোগাযোগের এক মাইলফলক স্থাপন করেন, উদ্বোধন হয় ‘লালন শাহ সেতু’।

২০০২ সালে বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে তিনি পাবনার চাটমোহরে আসেন, বিএনপি-জামায়াতের নৃশংস হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত খ্রিষ্টানপল্লীর অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান।

এরপর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যায়, ১/১১ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের টালমাটাল অবস্থা মোকাবিলা করে ও পরবর্তীতে ২০০৮ সালের নির্বাচনে ব্যালট বিপ্লবের মাধ্যমে জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাবনাবাসীকে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন রুপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার,সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তিনি পরিকল্পনা শুরু করেন এবং ২০১৩ সালের ২রা অক্টোবর ঈশ্বরদীতে রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ শুভ সূচনা করেন এবং উপস্থিত লক্ষ লক্ষ জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। পিতার পাবনাবাসীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি তিনি পূরণ করেন। তিনি বলেন, এই বিদ্যুৎ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তরের মধ্য দিয়ে রূপপুরসহ দেশবাসীর দীর্ঘদিনের অপেক্ষার অবসান হলো। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে দেশে যে এগিয়ে যাচ্ছে, এটা সে ধারাবাহিকতারই একটি মাইলফলক। সেদিন থেকেই শুরু হয় প্রথম পর্যায়ের ২৪টি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ, আজ এক দশক পর রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দৃশ্যমান রুপ আমাদের ঐদিনের কথা মনে করিয়ে দেয়।

পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধনের কয়েকদিন আগে ২০১৩ সালের ২রা ফেব্রুয়ারী তিনি পাবনায় অনেকগুলি উন্নয়ন কাজের উদ্বোধনে আসেন এবং পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ মাঠে জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। ঐদিন তিনি ঈশ্বরদী-পাবনা-ঢালারচর রেলপথ,পাবনা জেলা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট ভবন, বেড়া পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট,বেড়া পৌর ভবন, পাবনা বনমালী ইনস্টিটিউট মিলনায়তন, টেক্সটাইল কলেজ ভবন, পাবিপ্রবি স্বাধীনতা চত্বর,ছাত্রদের হল সহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প উদ্বোধন করেন।

এরপর তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর তিনি পাবনার রুপপুরের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে আসেন এবং এফসিডি কাজের উদ্বোধন করেন। পরের বছরই ১৪ই জুলাই তিনি আবারও পাবনা আসেন, আসেন পাবনাবাসীর জন্য উপহারের ডালা সাজিয়ে। তিনি রুপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের দ্বিতীয় ইউনিটের ফার্স্ট কংক্রিট পোরিং ডেট (এফসিডি) কাজের উদ্বোধন ও পাবনা-মাঝগ্রাম রেলপথের উদ্বোধনসহ অর্ধশতাধিক উন্নয়ন কাজের উদ্বোধন করেন এবং সেদিন পাবনা জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় পাবনার পুলিশ লাইনস মাঠে জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। ঐদিন তিনি বলেন,”আমরা এখন উন্নয়নশীল দেশ, কারো কাছে ভিক্ষা করে চলব না। জাতির পিতা বলেছিলেন, সাড়ে সাত কোটি মানুষকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, এগিয়ে যাব। বাংলাদেশকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারে নাই, দাবিয়ে রাখতে পারবে না। জাতির পিতার স্বপ্ন আমরা পূরণ করবই।”
চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে তিনি নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হোন তাই স্ব শরীরে পাবনায় তিনি উপস্থিত হতে পারেননি। বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ মহামারী বাংলাদেশে প্রবলভাবে ছড়িয়ে পরলেও তিনি তা বিচক্ষণতার সাথে মোকাবিলা করেন। এর পাশাপাশি সারা বাংলাদেশের ভূমিহীন গৃহহীন মানুষের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর প্রদানের মাধ্যমে তিনি এক অনন্য নজির স্থাপন করেন, এসময় পাবনার বিভিন্ন অঞ্চলের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর ও জমি হস্তান্তর অনুষ্ঠান উদ্বোধনে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে এ অঞ্চলের জনগণের হালহকিকতের খবর নেন। পাবনার গৃহহীন মানুষেরা ঘর পেয়ে ও জননেত্রীর সাথে কথা বলার সুযোগ পেয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পরে। তারা তাদের চির আপনজন বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকার জননেত্রী শেখ হাসিনাকে সেই ঘরে একদিন ডাল ভাত খাওয়ার দাওয়াত দেন। এছাড়াও ২০২০ সালের ২২ নভেম্বর পাবনার ঐতিহাসিক টাউন হলের নতুন সংস্করণ বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল স্বাধীনতা চত্বর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উদ্বোধনের সময় তিনি এই অঞ্চলের আওয়ামী লীগের নিবেদিত প্রাণ ও কীর্তিমান ব্যক্তিদের স্মরণ করেন, তিনি বলেন, “পাবনায় অনেক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব এসেছেন। আর জাতির পিতা তো বারবার সেখানে গেছেন। ওনি সারাজীবনে মনে হয় ১৩/১৪ বার পাবনায় মিটিং করেছেন। ছয় দফা দেবার পর পাবনায় জনসভা করার পর সেখান থেকে আসার সাথে সাথে তার বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছিল। সেখানে আমাদের অনেক পুরনো নেতারা ছিলেন।আফজাল সাহেব, বড় মিয়াসহ পুরনো বহু নেতাকর্মীসহ মোহাম্মদ নাসিমের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দুভার্গ্য যে আজকে কেউ নেই। এটা সত্যি আমাদের জন্য খুব কষ্টের।

বঙ্গবন্ধু যেমন পাবনার অস্তিত্বে মিশে আছে, বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাও তার জীবন ও কর্মের মাধ্যমে পাবনাবাসীর হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। তাইতো আজ পাবনার অলিতে গলিতে, মাঠে বাজারে বন্দরে এই অঞ্চলের মানুষের হৃদয়লিপি দিয়ে লেখা নাম ‘শেখ হাসিনা’।