অনলাইন জুয়া: লোভের ফাঁদে সর্বস্বান্ত হচ্ছে মানুষ

প্রাইভেট পড়ার ৫০০ টাকা শিক্ষককে না দিয়ে তা দিয়ে খেলা শুরু করেছিল তারা। শুরুতে প্রায় ১০ গুণ লাভও হয়। এরপর বাড়ি থেকে বিভিন্ন কৌশলে টাকা নিয়ে খেলায় হারতে হারতে শেষ পর্যন্ত মোবাইল ফোন বিক্রি করে দিতে হয়েছে। এটি নেশার মতো। খেলা শুরু করলে যতক্ষণ টাকা থাকে, ততক্ষণ খেলতে ইচ্ছা করে। কথাগুলো বলছিল পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার দুটি গ্রামের স্কুল ও কলেজপড়ুয়া দুই শিক্ষার্থী।

গেমের নামে অনলাইন জুয়া খেলে এভাবে সর্বস্বান্ত হচ্ছে উপজেলার হাজারো মানুষ। প্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে গ্রাম থেকে শহর– সর্বত্র বসছে জুয়ার আসর। সহজে বেশি টাকা উপার্জনের লোভে পড়ে শিক্ষার্থী, বেকার যুবক থেকে শুরু করে সব বয়সের মানুষ এতে জড়িয়ে পড়ছে। ঋণ নিয়ে কিংবা জমি বন্ধক রেখে আসক্তির মতো ঘটনাও ঘটেছে। অনেকে কৌতূহলে এ খেলা শুরু করলেও পরে নেশা হয়ে যাচ্ছে। শুরুতে কিছু লাভ হলেও পরে খোয়াচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক্ষতিগ্রস্ত এক নারী জানান, প্রথমে প্রতিবেশীর কথায় অল্প টাকা দিয়ে জুয়া খেলে লাভবান হন। এরপর লোভে পড়ে জমি বিক্রি করে প্রায় চার লাখ টাকা বিনিয়োগ করে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। একাধিক ব্যক্তির ভাষ্য, শুরুতে কিছুটা লাভবান হলেও পরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সবাই।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্মার্টফোনের মাধ্যমে মোস্টবেট, ওয়ান এক্সেট, বেট উইনার, বেট৩৬৫, মেলবেট, লাইনবেট, জিটুইন, ক্রিকেক্স, প্যারিম্যাচ, এমসিডব্লিউসহ বিভিন্ন অ্যাপ ডাউনলোড করে অনলাইনে খেলা হচ্ছে জুয়া। ১০ টাকা থেকে শুরু করে যে কোনো পরিমাণ অর্থ দিয়ে খেলা যায়। সাঁথিয়ায় মোস্টবেট ও ওয়ান এক্সেট অ্যাপ বেশি ব্যবহৃত যাচ্ছে। এগুলো পরিচালনা করা হচ্ছে রাশিয়া, মালেয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে। দেশের এজেন্টদের মাধ্যমে টাকা পাচার হচ্ছে বিদেশে।

অনলাইন এ জুয়ার কারণে বাড়ছে পারিবারিক অশান্তি। অনেকে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। এতে উদ্বেগ বাড়ছে অভিভাবকদের। এক নারী জানান, তাঁর স্বামী ক্যাসিনোসহ অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে টাকার জন্য তাঁকে নির্যাতন করতেন। এ নিয়ে কলহ দেখা দিলে তিনি পারিবারিকভাবে বিয়েবিচ্ছেদ করেছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক জানান, তাঁর ছেলে স্থানীয় উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে। কিন্তু অনলাইন জুয়ার কারণে পড়ালেখায় মনোযোগ নেই। কৌশলে টাকা নিয়ে এটা খেলে। কোনোভাবেই বিরত রাখা যাচ্ছে না। ছেলের ভবিষ্যৎ অনলাইন জুয়া নষ্ট করে দিচ্ছে।

খেলায় আসক্তরা জানিয়েছেন, এসব খেলা স্বাভাবিক গেমের মতো হওয়ায় আশপাশের মানুষ বুঝতে পারে না। গ্রামের বাজারের এজেন্টরা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা জমা কিংবা অ্যাকাউন্ট খুলে দেয়। প্রতি হাজারে তারা অন্তত ৪০ টাকা কমিশন পায়। যাদের স্মার্টফোন নেই, তারা ঘণ্টায় ২০০ থেকে ৩০০ টাকায় ভাড়া নিতে পারে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি গ্রামের এইচএসসি পরীক্ষার্থী জানায়, প্রথমে ৩৬ টাকা বিনিয়োগ করে ১৬ হাজার টাকা পায় সে। এরপর নেশায় পড়ে মোটরসাইকেল বিক্রি করে দেয়। পরীক্ষার সময়ও খেলা ছাড়তে পারেনি।

খেলার টাকা জোগাড় করতে মাদকের বিস্তারসহ বাড়ছে নানা অপরাধ। উপজেলার সরকারি চাকরিজীবীদের কোয়ার্টারে বসবাসকারী স্বাস্থ্য সহকারী নাসরিন সুলতানা জানান, গত ২৭ আগস্ট প্রবর্তনা ভবনের নিচতলায় তাঁর বাসায় দিনের বেলায় তালা ভেঙে চোরচক্র তিন ভরি স্বর্ণ ও প্রায় তিন লাখ টাকার সামগ্রী নিয়ে গেছে। ইউএনওর কার্যালয়ের ডিজিটাল সেন্টারের পরিচালক টেকনিশিয়ান মো. হাবিবুল্লাহ জানান, গত শনিবার রাতে রংধনু ভবনের দ্বিতীয় তলায় তাঁর বাসা থেকে স্বর্ণালংকার চুরি করেছে চোর। তিনি থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন।

যাদের এক সময় সংসার চলত না, তারা অনলাইনে জুয়া খেলে নতুন মোটরসাইকেল কিনে ঘুরে বেড়ায় বলে দাবি তেথুলিয়া গ্রামের মোত্তালিব হোসেন স্বাধীনের। তাঁর ভাষ্য, এসব ব্যক্তির প্ররোচনায় অনেকে জুয়ায় জড়িয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। জোড়গাছা ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক রাশেদ সালাহউদ্দিন বাবু বলেন, শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ রক্ষায় অভিভাবকদের ভূমিকা মুখ্য। শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে হবে শিক্ষকদের। সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা এবং নৈতিক শিক্ষায় গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। প্রশাসনেরও নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন।

সাঁথিয়া থানার ওসি রফিকুল ইসলাম বলেন, অনলাইন জুয়া শুধু সাঁথিয়া নয়, সারাদেশেই ছড়িয়েছে। এ বিষয়ে শুনেছেন, খোঁজও রাখছেন। জুয়ার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাসুদ হোসেন বলেন, অনলাইন জুয়ার বিষয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। লোকসমাগমস্থল বা কোনো অনুষ্ঠানে গেলে মানুষকে সচেতন করেন। আইনশৃঙ্খলা সভায় আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলেছেন। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সভা হলে তাদের সতর্ক করা হচ্ছে, যাতে আর্থিকভাবে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।