চলনবিল জাদুঘর: বিস্মৃত যত নীরব কাহিনি

সাদামাটা একতলা ঘরে ঢুকেই চোখে পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার কটি লাইন, ‘যাহাদের কথা ভুলেছে সবাই/ তুমি তাহাদের কিছু ভোলো নাই/ বিস্মৃত যত নীরবকাহিনী স্তম্ভিত হয়ে বও/ ভাষা দাও তারে হে মৌন অতীত/ কথা কও/ কথা কও।’

এই কাব্যর্থ দর্শনার্থীদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে তাঁরা এমন একটি ঘরে প্রবেশ করেছেন, যেখানে বিস্মৃত নীরব কাহিনি জমা করে রাখা হয়েছে। সংগ্রহশালাটি ঘুরে যে কারও মুখ দিয়ে আপনা–আপনি বের হয়ে আসবে, ‘সত্যিই তো।’

এই সংগ্রহশালাটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘চলনবিল জাদুঘর’। চলনবিলের কোল ঘেঁষে নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার খুবজীপুর গ্রামে ৪৫ বছর আগে সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চলনবিলের কিংবদন্তি শিক্ষক আবদুল হামিদ। তাঁর হাত ধরে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত জাদুঘরটি ১৯৮৯ সালের ২ জুলাই প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় আসে।

জাদুঘরের প্রথম কক্ষে ঢুকেই চোখে পড়ে তিন শ বছরের পুরোনো মনসামঙ্গল, সত্যপীরের পাঁচালিসহ গাছের বাকলে লেখা সংস্কৃত পুঁথি থরে থরে সাজানো। পাশেই রয়েছে বাদশাহ আলমগীর ও সম্রাট নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহের নিজ হাতে লেখা দুটি কোরআন শরিফ, তুলট কাগজে হাতে লেখা তিন-চার শ বছরের পুরোনো ৮টি সম্পূর্ণ ও ৭টি আংশিক কোরআন শরিফ, ১৫টি হাদিস শরিফ ও মহারানি ভবানীর নিজ হাতে লেখা দলিলসহ ২৫৭টি ধর্মগ্রন্থ। এসবই বন্দী করে রাখা হয়েছে কাচের আলমারিতে।

আলমারির সামনে মেঝেতে সারি করে রাখা হয়েছে পোড়ামাটির তৈরি সাতটি মনসা ঘট। প্রতিটি ঘটে রয়েছে সাপের মূর্তির বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি। জাদুঘরের কর্মচারী আবু বকর সিদ্দিক জানালেন, চলনবিলের দিঘি সুকনা (সিরাজগঞ্জের তাড়াশ) এলাকায় পুকুর খনন করার সময় এসব ঘট উদ্ধার করা হয়। এর পাশেই রয়েছে চলনবিলের দুর্লভ কিছু গাছের পাতা ও মাছ ধরার উপকরণ। এই কক্ষেই দেয়ালে সাঁটানো আছে উটের চামড়া দিয়ে বানানো ইসলামি জলসার (বাংলা ১৪০৮) একটি ব্যানার।

একপাশে রয়েছে নাটোরের পাগলা রাজার পরামর্শদাতা পণ্ডিত শ্রী বড়দা প্রসাদ শাস্ত্রীর আবক্ষ মূর্তি। পাশে অপর একটি কাচের আলমারিতে আটকে আছে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর হাতে লেখা ব্যক্তিগত ডায়েরি। একই আলমারিতে রয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ের সাবেক মহাপরিচালক আবদুর রহীমের (চলনবিলের সন্তান) অতি ক্ষুদ্রাকার হস্তলিপি। পাশের আলমারিতে রয়েছে কষ্টি পাথরের সূর্যদেব, বিঞ্চু ও মাতৃকামূর্তি। রয়েছে ৯০টি দেশের মুদ্রা ও বিভিন্ন শাসনামলের টেরাকোটা। একসময় এই আলমারিতে রাখা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের অভিভাষণের প্রতিলিপি। বতর্মানে এটি সংরক্ষণের সুবিধার জন্য মহাস্থানগড় জাদুঘরে স্থানান্তর করা হয়েছে।

পরের কক্ষটিতে ঢুকে প্রথমেই চোখে পড়বে তিন থেকে চার মাথার বাঁশের অংশবিশেষ। প্রাচীন আমলের তৈরি ইট, পাথর, কড়ি ও ধাতব তৈরির তৈজসপত্র, চলনবিলের দস্যুদের ব্যবহৃত তলোয়ার, বুলেট। এ ছাড়া চলনবিলের দুর্লভ কিছু ফলের মমি। গুরুত্বপূর্ণ দলিলের মধ্যে রয়েছে ১৯৭২ সালে রচিত বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান।

শুরুতে এটি চালু করা হয় খুবজীপুর দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের একটি ভবনে। পরে ১৯৮৪-৮৫ সালে নরওয়ের দাতা সংস্থা নোরিড এবং ১৯৮৫-৮৬ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অর্থসহায়তায় সরকারি একখণ্ড জমিতে জাদুঘরটির জন্য একটি দ্বিতল ভবন নির্মাণ করা হয়। জরাজীর্ণ হওয়ায় সম্প্রতি দোতলার কক্ষগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে। বর্তমানে ভবনের নিচতলার দুটি কক্ষে জাদুঘরটি চালু আছে।

বগুড়ার মহাস্থানগড় জাদুঘরের অধীনে এটি পরিচালিত হয়। গ্রীষ্মকালে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এবং শীতকালে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত চলনবিল জাদুঘর সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে। বন্ধ থাকে প্রতি রোববার।

জাদুঘরটির প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক এম এ হামিদ মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। তাঁর ছাত্র মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী আবদুল ওয়াহাব জানালেন, চলনবিল অঞ্চলের প্রাচীন কীর্তি সম্পর্কে গবেষণা করে লুপ্ত ইতিহাস উদ্ধার, প্রাচীন ঐতিহাসিক ও কৃষ্টিগত নিদর্শন, শিলালিপি, টেরাকোটা এবং বিভিন্ন দর্শনীয় বস্তু, মাছ, ঝিনুক, শামুক ইত্যাদির নমুনা সংরক্ষণসহ অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে সেতুবন্ধ রচনার অভিপ্রায়ে এই জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।

২০১৬ সালে জেলা প্রশাসক খলিলুর রহমান (বর্তমানে ভূমিসচিব) পরিদর্শন বইতে লিখেছেন, ‘সুন্দর পরিবেশ। জাদুঘরে কিছু মূল্যবান নিদর্শন রয়েছে। বিশেষ করে ১৯৭২ সালের সংবিধান। তবে কক্ষ দুটি জরাজীর্ণ, স্যাঁতসেঁতে। মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণের উপযোগী নয়।’

জাদুঘরটির সঙ্গে এলাকাবাসীর আবেগের সম্পর্ক। এর জন্য নতুন ভবন নির্মাণ করা, কর্মী নিয়োগ দেওয়াসহ প্রত্নসামগ্রী সংরক্ষণে আরও যত্নবান হওয়ার কথা বললেন চলনবিল গবেষক ও নাটোরের নবাব সিরাজ উদ দৌলা সরকারি কলেজের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আকরাম হোসেন সরকার।