বড়াল একটি নদীর নাম: হাবিবুর রহমান স্বপন

উত্তর জনপদের অন্যতম একটি নদী বড়াল। ২২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের নদীটি আশির দশেকেও ছিল স্রোতস্বিনী। এখন এটি মৃতপ্রায়। গড় প্রস্থ ৬৩ মিটার এবং সর্পিল আকারের। বড়াল নদীর উৎপত্তি রাজশাহী জেলার চারঘাট থেকে পদ্মা নদীর শাখা হিসেবে। রাজশাহীর চারঘাট থেকে বাঘা, নাটোরের বাগাতিপাড়া, বড়াইগ্রাম, পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, সাঁথিয়া ও সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাঘাবাড়ি হয়ে বেড়া বাজারের অদূরে হুড়াসাগর নদীতে মিশেছে।
বড়াল চলনবিলের পানি প্রবাহের প্রধান সংযোগ নদী। বড়ালের পানি প্রবাহ হ্রাস পাওয়ায় চলনবিলের বিশাল অংশ শুকিয়ে গেছে। ১৯৮৫ সালে নদীর উৎসমুখ চারঘাটে একটি স্লুইস গেট নির্মাণ করায় পানিপ্রবাহ কমতে থাকে। ৪৬ কিলোমিটার ভাটিতে পাবনার আটঘড়ি নামক স্থানে আরও একটি স্লুইস গেট, বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়া এলাকায় তীর দখল, পাবনার চাটমোহর এলাকায় ৩টি আঁড়া-আঁড়ি বাঁধ নির্মাণ এবং দহপাড়ায় আরও একটি স্লুইস গেট নির্মাণ করায় বড়াল নদীর পানিপ্রবাহ কমতে থাকে। ক্রমান্বয়ে নদীটি সংকীর্ণ হতে থাকে।
বড়াল নদী তীরবর্তী এলাকায় একসময়ে জাঁকজমকপূর্ণ নদী বন্দর ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা গড়ে ওঠে (আড়ানি, রুস্তমপুর, জামনগর, বাঁশবাড়িয়া, তমালতলা বাজার, বাগাতিপাড়া থানা, দয়ারামপুর সেনানিবাস, বনপাড়া, চাটমোহর, ভাঙ্গুরা, বনোয়ারি নগর ফরিদপুর, ডেমড়া) ব্যবসা বাণিজ্যে এবং প্রশাসনিক কার্যক্রমে ভাটা পড়ে।
যেমন দেখেছি বড়ালের রূপ :
ষাটের দশকে ১৯৬৩ থেকে ১৯৭৫, ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৫ এবং তৎপরবর্তীকালে বড়াল নদীকে তিন রূপে দেখলাম।
আমার বয়স তখন ৭ বছর (১৯৬৩ সাল) বড়াল নদী তীরে নানা বাড়ি (সাঁথিয়া উপজেলার ছোট পাথাইলহাট গ্রামে)। সাঁতার শিখেছি বড়াল নদীতে। বড়ালে তখন মাঝেমধ্যেই কুমিরের দেখা মিলতো। ছিল প্রচুর শিশুক। শিশুকগুলো পানিতে খেলতো উঠতো আর ডুব দিতো। প্রচুর মাছ ছিল।
বারোমাস নদীতে গড় ৫০/৬০ ফুট গভীর পানি থাকতো। বর্ষাকালে নদীতে পানি প্রবাহ বাড়তো। গভীরতা বেড়ে দাঁড়াতো ৯০ থেকে ১১০ ফুট। নদীর পাড় উপচে মাঠ-ঘাট ডুবে যেতো।
চৈত্র-বৈশাখ মাসেও বড়াল নদীতে চলতো বড় বড় মালবাহী নৌকা এবং স্টিমার ও লঞ্চ।
বর্ষাকালে নদীতে জেলেদের পাশাপাশি গ্রামবাসী মাছ শিকার করতো। প্রচুর ইলিশ মাছ শিকার হতো। আমি আমার মামাতো ভাই এবং প্রতিবেশি খেলার সাথীদের সঙ্গে সখে ইলিশ শিকারে যেতাম। আষাঢ়ে যখন জেয়ারের পানি ঢুকতে বড়ালে তখন নতুন পানিতে আসতো বড় বড় চিংড়ি, বেলে, বাইন, কাকলে, গুজা আইড়, ট্যাংরা, জিওল, মাগুর, শিলন, টাটকেনি,বাটকে, কৈ, পাঙ্গাশ, ভোল, বোয়াল ও আইড় মাছ। নদী তীরের লোকজন নদীতে ছোট বড় মাছ ধরার ফাঁদ (দোয়াইর, খাদুম, চারো, জাল ইত্যাদি) পেতে রাখতো, এছাড়াও ঝাঁকি জাল, ডোরা জাল, খোঁড়া জাল, বেড় জালে মাছ ধরতো জেলেরা। তাতে প্রচুর মাছ মিলতো। সকালে উল্লিখিত মাছ ধরার ফাঁদ যখন উঠানো হতো তখন শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষ সকলেই আনন্দে আত্মহারা হতো। কত প্রকার মাছ ধরেছি এখন সব মাছের নামও মনে নাই। ঠ্যাং ওয়ালা চিংড়ি, ম্যাটরা, গাঙঘাইরা, বাচা, খলসে, সর পুঁটি, রয়না, কাউনে, আইড়, বোয়াইল, বাইন,বেলে, রুই, কাতল, বাঘা আইড়, চিতল, পাবদা, ফাতাসি, বাঁশ পাতারি, কাজলি, বাটা ইত্যাদি।
বড়ালে প্রচুর জোঁক ছিল। মাছ মারতে যেয়ে এবং গোছলে নেমে বহু জোঁকের শিকার হয়েছি। প্রথমে ভয় করতো পরে জোঁক প্রুফ হয়ে গিয়েছিলাম।
বড়ালে প্রতিদিন দুটি স্টিমার চলতো। ঢাকা সদরঘাট থেকে একটি স্টিমার যেতো বড়াল ব্রিজ স্টেশন পর্যন্ত। অপরটি আসতো নারায়ণগঞ্জ থেকে।
আমরা স্টিমারের হুইসেল উপভোগ করতাম। একটির হুইসেলে শব্দ হতো কুকুরের ঘেউ ঘেউ। অপরটিতে হতো সুন্দর বাঁশির সুর। কখনও কখনও অপর একটি স্টিমার চলতো (বিকল্প হিসেবে) সেটির হুইসেল ছিল সমধুর মোরগের ডাক। স্টিমার যেসব স্টেশনে বা ঘাটে ভিড়তো তার একটি ছিল আমার নানা বাড়ির পূর্ব দিকের সেলন্দা ঘাটে এবং পশ্চিম দিকের নাগডেমড়া ঘাটে। ঘাটে ভেরার আগে স্টিমার হুইসেল বাজাতো। আমরা ইস্টিমারের হুইসেল শুনে দৌড়ে নদী তীরে দাঁড়াতাম। স্টিমার ঘাট অতিক্রম করার সময় যে ঢেউ উঠতো সেই ঢেউ আছড়ে পড়তো নদী তীরে। আমরা সেই ঢেউয়ের জলে পা ধুয়ে নিতাম। ঢেউয়ে ডাঙায় উঠে আসতো মাছ। মাছ ধরার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়তাম। সে কি আনন্দ।
চাঁদপুর, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ থেকে পণ্য বোঝাই মালামাল আসতো নদী তীরবর্তী বন্দরসমূহে। আসতো কেরোসিন তেল, আলকাতরা, ঢেউ টিন, লবন, সাবান,সোডা, সিমেন্ট, ইত্যাদি। আর রাজশাহী, পাবনা, নাটোরের নদী বন্দর থেকে ফিরতি নৌকায় ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, চাঁদপুরে যেতো ধান, পাট, সরিষা, ডাউল জাতীয় ফসল, পিঁয়াজ, মরিচ, পটল, করল্লা ইত্যাদি সব্জি।
বিশাল বিশাল নৌকা। কোনটিতে ১৬ জন মাল্লা দাঁড় টানতো। বিশাল পাল তোলা নৌকাগুলো চলতো মানুষচালিত বৈঠা এবং দাঁড় এর সাহায্যে। যখন বাতাস থাকতো না তখন নৌকার মাস্তুলে গুণ (এক ধরনের শক্ত রশি) বেঁধে টেনে নিতো নৌকার মাঝিরা। চার থেকে দশজন পর্যন্ত ছিল গুণ টানার শ্রমিক। অর্থাৎ নৌকা চালানো ছিল কঠিনতম পরিশ্রম সাধ্য কাজ।
১৯৭৫ সালে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করার ফলে পদ্মা নদীতে পানি প্রবাহ হ্রাস পায়। তার প্রভাব পড়ে বড়াল নদীর ওপর। চারঘাটের উৎপত্তিস্থল থেকেই বড়ালে পানির চাপ কিছুটা হ্রাস পায়। এই হ্রাসের বিষয়টি স্পষ্ট হতে থাকে শুকনো মৌসুমে। তখনও বড়াল বর্ষাকালে ভয়াল রূপ নিতো।
১৯৮৫ সালে চারঘাটে স্লুইস গেট নির্মাণ কাজ শেষ হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড এই স্লুইস গেট নির্মাণ করে।
এরপর বড়াল মরতে থাকে।
ষাটের দশকে আড়ানি ও বাঘা থেকে নৌকা বোঝাই আম ও কাঁঠাল চালান হতো ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, চাঁদপুর। নৌকায় আম আসতো এবং পঁচে যেতো। মাঝিরা প্রতিদিন পচনশীল আম ও কাঁঠাল যাত্রা পথের নদী তীরের বাজারে বিক্রি করতো আর গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হতো। যেসব আম কাঁঠাল বেশি পঁচে খাওয়ার অনুপোযোগী হতো সেগুলে নদীতে ফেলে দিতো।
এভাবেই তখন নৌপথে কাঁচা পণ্য মোকামে পরিবহন করা হতো।
বড়াল নদী তীরের জনপদ ছিল ফসলে সমৃদ্ধ। দুই তীরে জল সেচের উৎস্যই ছিল বড়াল নদী।
নদী তীরের কোন অধিবাসী মাছ কিনে খায়নি।
নদীতে প্রচুর কচ্ছপ ছিল। বর্ষায় স্রোতে ধরা পড়তো কচ্ছপ ও দুরা। বড়াল এবং এর সঙ্গে সংযুক্ত নদী সমূহ (ইছামতি, গুমনাই, গুড়, নন্দকূজা, বলেশ্বর) থেকে কচ্ছপ ও দুরা ধরতো উড়িয়ারা। উড়িয়ারা আসতো ভারতের উরিষ্যা রাজ্যের কটক ও বিশাখাপত্তম থেকে। বড়ালের মাছ ও কচ্ছপ-দুরা রেল যোগে বড়াল ব্রিজ ও লাহিড়ি মোহনপুর স্টেশন থেকে সিরাজগঞ্জ-কলকাতা মেলে চলে যেতো কলকাতায়। কলকাতার বাজারে এই এলাকার ঘি যেতো লাহিড়িমোহনপুর ও বড়াল ব্রিজ স্টেশন থেকে।
বড়ালের তীরবর্তী এলাকায় ছিল অনেক জেলে বসতী। নদী মরে যাওয়ার পর জেলেরা দেশ ছেড়েছে।
তখন ছিল ‘জাল যার জলা তার’ নীতি। অতএব নদীতে মাছ শিকার করে জেলেরা জীবিকা নির্বাহ করতো। এখন অবশ্য মুক্ত জলাশয় নেই বললেই চলে। যা আছে সেগুলো যখন যে দল ক্ষমতায় তখন তারা জলাশয় দখল করে লুটেপুটে খায়।
বড়ালের স্রোতের মাছের স্বাদ ছিল অতুলনীয়।
একবার এক বাঘাইড় মাছে ধরা পড়েছেল সাড়ে তিন মন ওজনের। দৈত্যাকারের মাছটি আমার নানা বাড়িতে আনা হয়। উঠানে তাড়াই আর চট এবং তার উপর কলাপাতা বিছিয়ে কুড়াল দিয়ে কাটা হলো। রক্ত আর রক্ত! মাছে এতো রক্ত।
সেই মাছে কেটে গ্রামবাসীদের মধ্যে বন্টন করা হয়েছিল। বড়ালে আমি বিশাল আকৃতির বোয়াইল এবং চিতল দেখেছি এবং খেয়েছি।
বড়ালের পানি উপচে বর্ষাকালে যখন বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে যেতো তখন মনে হতো অথৈ সমুদ্র যেন। রাউতারার পাথার। একুল থেকে ওকুল দেখা যেতো না।
বড়াল নদীতে মালবাহী বিশালাকৃতির গুদাম ওয়ালা বজরা নৌকা যেমন দেখেছি তেমনই কত প্রকার নৌকা যে দেখেছি তার সবগুলোর নাম মনে নেই। মাছ ধরার জন্য জেলেদের নৌকা ছিল কয়েক প্রকার। বড় নৌকা, ইলসা, ডিঙি নৌকা, কোষা নৌকা। আরও দেখেছি, পানসি, ঘাসি, বাইচের নৌকা, সাম্পান, গয়না, পাতাম, বাচারি, লম্বা পদি, তালের কোন্দা নাও, ময়ূরপঙ্খি, সওদাগরি, ডোঙা, ছিপ নৌকা ইত্যাদি।