গ্রেনেড হামলার ১৯ বছর, এখনো শুকায়নি ২১ আগস্টের ক্ষত

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ২১ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কলঙ্কময় ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ভয়াল দিন।

২১ আগস্ট উপলক্ষ্যে রোববার দেওয়া এক বাণীতে তিনি বলেন, ২০০৪ সালের এ দিনে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বিরোধী সমাবেশে বর্বরতম গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এ হামলার মূল লক্ষ্য ছিল দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করা এবং আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশকে নেতৃত্বশূন্য করে হত্যা, ষড়যন্ত্র, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, দুর্নীতি ও দুঃশাসনকে চিরস্থায়ী করা।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “মহান আল্লাহর অশেষ রহমত ও জনগণের দোয়ায় আমি অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যাই। আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মীরা মানববর্ম তৈরি করে আমাকে রক্ষা করেন। তবে সন্ত্রাসীদের গ্রেনেড হামলায় বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভানেত্রী বেগম আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতা-কর্মী নিহত হন; আহত হন ৫ শতাধিক নেতা-কর্মী, সাংবাদিক ও নিরাপত্তাকর্মী। তাদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গুত্ববরণ করেছেন। অনেকে দেহে স্প্লিন্টার নিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। আমি ২১ আগস্টের সব শহীদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি এবং আহতদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।”

শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সবসময় জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের মদদ দিয়ে বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র বানানোর অপচেষ্টা করে আসছে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর নির্বাচনে কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে সারাদেশে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে এই জোট। একের পর এক বোমা হামলা, গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তারা দেশটিকে জঙ্গিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা চালায়।

এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বিরোধী সমাবেশে তারা গ্রেনেড হামলা চালায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রকাশ্য দিবালোকে রাজনৈতিক সমাবেশে এ ধরনের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এ নারকীয় হামলা ও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে বিচার করা ছিল সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে, উল্টো হত্যাকারীদের রক্ষায় সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। হামলাকারীদের বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। গুরুত্বপূর্ণ সব আলামত ধ্বংস করে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে অপব্যবহার করে তারা ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজায়। পরবর্তীকালে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তে বেরিয়ে আসে হাওয়া ভবন ও বিএনপি-জামায়াত জোটের অনেক কুশীলব এ হামলার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল। দীর্ঘ ১৪ বছর পর ২০১৮ সালের অক্টোবরে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার রায় হয়।

আদালত গ্রেনেড হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে বিএনপি নেতা সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। একই সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিদেশে পলাতক তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়া বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়েছে ১১ আসামির।

তিনি বলেন, এই রায়ের মধ্য দিয়ে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আশা করি, সব আইনি বিধিবিধান ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় দ্রুত কার্যকর হবে। এই রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে দেশ থেকে হত্যা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের চির অবসান হবে; জাতি কলঙ্কমুক্ত হবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোটের সব অপচেষ্টা ও ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে বাংলাদেশের জনগণ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করে। ২০০৯ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে সরকার গঠন করে মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য আমাদের সরকার নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিহিংসার রাজনীতি বাদ দিয়ে দেশে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করে দেশে শান্তি ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

গত সাড়ে ১৪ বছরে আমরা প্রতিটি ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি অর্জন করেছি। এই সময়ে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জন করেছে। আমরা আজ আত্মমর্যাদাশীল দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছি।

তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল, তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। ২১ আগস্টের বীভৎস হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে একটি কলঙ্কময় অধ্যায় হিসেবেই চিহ্নিত থাকবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী এখনও নানাভাবে ষড়যন্ত্র করছে। আসুন, ঐক্যবদ্ধভাবে এই অপশক্তির যে কোনো চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে আগামী প্রজন্মের জন্য বাংলাদেশকে একটি নিরাপদ-শান্তিপূর্ণ আবাসভূমি হিসেবে গড়ে তুলি।’

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ভয়াল সেই গ্রেনেড হামলায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।

সোমবার (২১ আগস্ট)  সকালে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ২১ আগস্টের নিহতদের স্মরণে নির্মিত অস্থায়ী স্মৃতিফলকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন প্রধানমন্ত্রী।

সকাল ১০টা ৫৮ মিনিটে প্রথমে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন শেখ হাসিনা। এরপর আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর হামলায় আহতদের সঙ্গে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।

শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা স্মরণে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আয়োজিত আলোচনা সভায় অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত (বেলা ১১টা ৫ মিনিট) আলোচনা সভা চলছে।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের ‘সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতিবিরোধী’ সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় দলটির তৎকালীন মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হন। আহত হন পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী। আহতদের অনেকে এখনও শরীরে গ্রেনেডের স্প্লিন্টার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

জানা গেছে, ২১ আগস্টে নিহতদের অধিকাংশ এবং আহতদের মধ্যে ৩৩ জনকে ঢাকায় ফ্ল্যাট দিয়েছে আওয়ামী লীগ। প্রায় সব আহতদের দেশ-বিদেশে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আহতদের অনেককে সঞ্চয়পত্র করে দেওয়া হয়েছে, যেখান থেকে মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। যা দিয়ে তাদের ওষুধের খরচ হয়। আহতদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেশিরভাগের শরীরে এখনো রয়ে গেছে স্প্লিন্টার। দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা সংকটের দানা বাঁধছে দেহে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা হলে তারা আরও সুস্থ হবে বলে আশা করছেন। এজন্য সবার নজর আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার দিকে। তিনি ছাড়া কেউ তাদের খবর নেন না।