কচুরিপানা থেকে তৈরী হচ্ছে নজরকাড়া হস্তশিল্প

এক সময়ে অবহেলিত কচুরিপানা থেকে এখন পাবনায় তৈরী হচ্ছে হস্তশিল্পের নজরকাড়া ও পরিবেশবান্ধব বিভিন্ন রকম পণ্য। সাশ্রয়ী দামে এসব পণ্যের চাহিদা বাড়ছে দেশ-বিদেশে। বর্তমানে জেলা থেকে তৈরী কচুরিপানার পরিবেশবান্ধব পণ্য রপ্তানী হচ্ছে ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে। এতে বছরে আয় হচ্ছে অন্তত দেড় থেকে দুই কোটি টাকা।

একসময় দেশে কচুরিপানা এতই ভয়ঙ্কর অবস্থা ধারন করেছিল যে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রীতিমত কচুরিপানা বিরোধী গান লিখেছিলেন যা কবির ‘শেষ সওগাত’ নামের কাব্যগ্রন্থে সংকলিত করা হয়েছে। জ্যাতিমিক হারে রাতারাতি বংশবৃদ্ধি করা কচুরিপানা নিধনে আইন পর্যন্ত পাশ করাও ইতিহাসও রয়েছে দেশে। কিন্তু তিরস্কার দেয়া সেই ফেলনা কচুরিপানাই এখন জোগান দিচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। বছরে কোটি টাকা আয় আসছে কচুরিপানা থেকে তৈরী হস্তশিল্প রপ্তানিতে।

পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার রসুলপুর গ্রামের জয়তুন খাতুন-রফিকুল ইসলাম দম্পতি গড়ে তুলেছেন কচুরিপানা দিয়ে তৈরী এমনই এক কুটিরশিল্প। যেখানে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে কচুরিপানা ক্রয়-বিক্রয় ও পণ্য তৈরির কাজ। তিন বছর আগে স্বামীর সাথে ঢাকায় রপ্তানীকারক হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠান বিডি ক্রিয়েশনে যান জয়তুন খাতুন। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন কচুরিপানা দিয়ে নানারকম পণ্য তৈরির বিষয়টি। তখন থেকে বিডি ক্রিয়েশনের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিয়ে কচুরীপানা দিয়ে হস্তশিল্প পণ্য তৈরী শুরু করেন রফিকুল-জয়তুন দম্পতি।

কচুরিপানা প্রক্রিয়াজাত করে টব, ফুলদানি, বালতি, পাটি, ট্রে, ফলঝুড়ি, ডিম রাখার পাত্র, পাপোশ, মোড়া, টুপি, আয়নার ফ্রেম, ডাইনিং টেবিলের ম্যাটসহ বর্তমানে ১০ রকমের পণ্য উৎপাদন ও বিক্রি করছেন তারা। তাদের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে আশপাশের ৩০ জন নারীর। আার কচুরিপানা ঘিরে কর্মসংস্থান হয়েছে ১৫টি গ্রামের অন্তত তিনশ’ পরিবারের। তারা বিভিন্ন এনজিও থেকে চড়া সুদে ঝণ নিয়ে এ ব্যবসা করে খুব একটা লাভ করতে পারছে না। তবে সরকারী সহযোগিতা পেলে গ্রামের হাজার নারীকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব বলে জানান তারা। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চলে কচুরিপানা ক্রয়-বিক্রয় ও পণ্য উৎপাদন। এখানে কচুরিপানা থেকে টব, ফুলদানি, বালতি, পাটি, ট্রে, ফলঝুড়ি, ডিম রাখার পাত্র, পাপোশ, মোড়া, টুপি, আয়নার ফ্রেম, ডাইনিং টেবিলের ম্যাটসহ ২০ ধরনের পণ্য তৈরি হচ্ছে। ৬০ থেকে ৭০ জন শ্রমিক কাজ করছেন, বেশিরভাগই নারী।

খাল-বিল, নদী-নালা, পুকুরে অযত্নে বেড়ে ওঠা কচুরিপানা থেকে পাবনায় তৈরি হচ্ছে হস্তশিল্পের নজরকাড়া পণ্য। সাশ্রয়ী দামের এসব পণ্যের চাহিদা বাড়ছে দেশ-বিদেশে। বর্তমানে জেলা থেকে কচুরিপানার হস্তশিল্প যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ বেশ কয়েকটি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। কাঁচা ও শুকনো কচুরিপানাকেন্দ্রিক সাঁথিয়ার ১৫ গ্রামের অন্তত ৩০০ পরিবার জীবিকা নির্বাহ করছে।

শ্রমিকরা বিভিন্ন আকারের ফুলের টব তৈরিতে ৪০ থেকে ১০০ টাকা মজুরি পান। একইভাবে ফলঝুড়িতে ১০০ থেকে ২৫০, পাপোশে ৩০, ফুলদানি ও ট্রেতে ৩৫ থেকে ৭০ ও আয়নার ফ্রেম বাবদ ৪০০ থেকে ৪২০ টাকা মজুরি পান। এসব পণ্য কেউ কারখানায় বসে তৈরি করেন; বাড়িতে করেও কারখানায় জমার সুযোগ রয়েছে। কচুরিপানা শুকানোর কাজ থেকে শ্রমিকরা গড়ে দিনে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় করতে পারেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, সাঁথিয়ার ঘুঘুদহ, গৌরীগ্রাম, দোপমাজগ্রাম, ধাতালপুর, ক্ষেতুপাড়া, মিয়াপুর, বহলবাড়িয়া, বানিয়াবহু, গাঙ্গুয়াহাটি এবং পার্শ্ববর্তী বেড়া উপজেলার জগন্নাথপুর, হাটুরিয়া, নাকালিয়াসহ ১৫টি গ্রামের মানুষ প্রতিদিন কচুরিপানা বিক্রি করতে আসেন রফিকুল কুটিরশিল্পে। দিনে গড়ে ৫০ থেকে ৬০ মণ কাঁচা এবং ৫-৭ মণ শুকনো কচুরিপানা ক্রয়-বিক্রয় হয়। প্রতি মণ কাঁচা কচুরিপানা ১০০ থেকে ১২০ এবং শুকনো বিক্রি হয় ১ হাজার ৮০০ টাকায়।

রফিকুল কুটিরশিল্পের স্বত্বাধিকারী জয়তুন খাতুন কচুরিপানা দিয়ে পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি এগুলো বিক্রি করেন। তিনি পাবনার ঈশ্বরদীর দাশুরিয়ায় রৌপ্য পদকপ্রাপ্ত কারখানা ‘বিডি ক্রিয়েশনে’ এগুলো বিক্রি করেন। খুলনার একটি কারখানাতেও তিনি পণ্য ও কচুরিপানা সরবরাহ করেন। সেখানে কচুরিপানা থেকে কাগজ, কাগজের পুতুল, নোটবুক, ওয়ানটাইম গ্লাস-প্লেটসহ বাহারি পণ্য তৈরি হচ্ছে। জয়তুন জানান, সাত বছর ধরে এ ব্যবসা করছেন তিনি। খরচ বাদে প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় হয়।
বিডি ক্রিয়েশনের কর্ণধার আব্দুর রহমান আশিক জানান, শুকনো কচুরিপানা কিনে প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে তাঁরা বাহারি সব পণ্য তৈরি করেন। কারখানায় ৮০০ শ্রমিক কাজ করেন। আটটি দেশে কচুরিপানার তৈরি পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। আরও কয়েকটি দেশের সঙ্গে আলোচনা চলছে। প্রতি বছর দেড় থেকে ২ কোটি টাকার এসব পরিবেশবান্ধব পণ্য রপ্তানি করছেন।

কচুরিপানা থেকে উৎপাদিত প্রতিটি ফুলের টব ২০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা, ফুলদানি ২৫০ থেকে ৪০০, বালতি ২০০ থেকে ১ হাজার, পাটি ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৬০০, গ্লাসপট ১৮০ থেকে ২২০, ট্রে ২০০ থেকে ৩০০, ফলঝুড়ি ২০০ থেকে ১ হাজার, ডিম রাখার পাত্র ৬০০ থেকে ১ হাজার ১০০, পাপোশ ২০০ থেকে ৩০০, আয়নার ফ্রেম ১ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ৫০০, ডাইনিং টেবিলের ম্যাট ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

সাঁথিয়ার ধাতালপুরের ইন্তাজ আলী, মিয়াপুরের নাজমুল মিয়া ও বানিয়াবহুর মজিবুর রহমান জানান, প্রতিদিন ৮০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকার কচুরিপানা বিক্রি করেন তাঁরা। হস্তশিল্প শ্রমিক কৃষ্ণ দাস জানান, দিনে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা রোজগার করছেন তিনি। গৌরীগ্রামের মিজান জানান, কচুরিপানা বিক্রি করে তিনি ৬৫ হাজার টাকার ঋণ শোধ করেছেন।

কিভাবে শুরু হলো জানতে চাইলে জয়তুন খাতুন বলেন, বিয়ে হয়ে স্বামীর বাড়িতে আসার পর দেখেছি আমার শশুড় বেতের ব্যবসা করতেন। সেটা দেখে আমার স্বামীও ব্যবসা শুরু করেন। এরপর তিন বছর আগে মাথায় আসে বেতের জিনিসপত্র এত দাম দিয়ে যারা কেনে, তারা কিভাবে কি করে, কেন কেনে, সেটা দেখা দরকার। আমার স্বামীর সাথে ঢাকায় যাই বিডি ক্রিয়েশনে। সেখানে গিয়ে দেখতে ও জানতে পারি কচুরীপানা দিয়ে নানারকম পণ্য তৈরী করছে। তখন আমাদের মাথায় আসে আমরাও এটা করতে পারি। তখন বিডি ক্রিয়েশনকে বলি আমাদের শিখিয়ে দেন আমরাও এটা করবো। তারপর সেখান থেকে তিনজন মাস্টার আমাদের গ্রামে এসে হাতেকলমে শিখিয়ে দেন। এভাবেই শুরু করি। তারপর গ্রামের নারীদের এ কাজে আমরা সম্পৃক্ত করি। বর্তমানে ৩০-৪০ জন নারী কচুরীপানা দিয়ে হস্তশিল্পের পণ্য তৈরীর কাজ করছে। বর্তমানে ১০ রকমের পণ্য তৈরী করে বিক্রি করছি। খরচ বাদে প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় হয়। তিনি বলেন, আমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা এটিকে আমরা অনেকদূর এগিয়ে নিতে চাই। আরও বড় পরিসরে করতে চাই। কিন্তুআর্থিক সংকটে এগুতে পারছি না। এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে লাভ বেশি হচ্ছে না। সরকার যদি অল্প সুদে আমাদের ঋণ দেয় তাহলে আমি এই কাজে গ্রামের অন্তত ২ হাজার নারীকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারবো।