পণ্যের রফতানি বহুমুখী করতে হবে

দেশের রফতানিকে বৈচিত্র্যময় করে তোলা যাতে ২০২৬ সালে এলডিসির উত্তরণের পরে বিদ্যমান এবং নতুন চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় সহায়তা করতে পারে। তৈরি পোশাক খাত বা আরএমজি খাত বাংলাদেশের রফতানির জন্য একটি সফল মডেল কিন্তু এখন সময় এসেছে চামড়া, টেক্সটাইল, ফার্মাসিউটিক্যালস, আইসিটি এবং হালকা প্রকৌশলের মতো অন্যান্য সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে ফোকাস করার। জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) থেকে উত্তরণের পর কীভাবে তার রফতানির পরিধি বৃদ্ধি করা যায় সে বিষয়ে বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা শুরু করেছে।  থাইল্যান্ড রফতানি বহুমুখীকরণের একটি সফল উদাহরণ, প্রাকৃতিক সম্পদভিত্তিক শিল্প (যেমন কৃষি ও মৎস্য পণ্য) আপগ্রেড করার জন্য এবং শ্রমনিবিড় উৎপাদিত রফতানি, বিশেষ করে পোশাক এবং ইলেকট্রনিক্সকে উৎসাহিত করার জন্য একটি দ্বৈত কৌশল গ্রহণ করেছে। চীনের সঙ্গে সব পূর্ব এশিয়ার অর্থনীতি আঞ্চলিক বিষয়গুলোকে অর্থনৈতিক একীকরণের মাধ্যমে উপকৃত হয়েছে। ক্রস-কান্ট্রি প্রোডাকশন নেটওয়ার্কের একীকরণের মাধ্যমে উৎপাদন চেইনের অবস্থান সংহত করেছে এর কারণে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো জাতীয় সীমানা ছাড়িয়ে কম খরচে উৎপাদন করার যে সুবিধা চেয়েছিল তার ব্যবস্থা থাইল্যান্ড করেছে।

এ ছাড়াও বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটকে (বিএসটিআই) শক্তিশালী করা যাতে স্থানীয় পণ্যগুলোর গুণগত মান নিশ্চিত করা এবং যেসব পণ্য আন্তর্জাতিক মানের জন্য পরীক্ষার সম্মুখীন হয় সেগুলোকে আরও ভালোভাবে এগুলোর গুণগত মান যাচাই করা। এ কারণে দেশের আইনি সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। কারণ বাণিজ্যিক বিরোধ এলডিসি উত্তরণ পর্যায়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে। আন্তর্জাতিক রফতানি বাজারে প্রতিযোগিতা করতে পাট, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, চামড়াজাত পণ্য, জুতা, ফার্মাসিউটিক্যালস, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, আইসিটি এবং অন্যান্য উদীয়মান খাতের মতো ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে সব ধরনের প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হবে। ঐতিহ্যগত শিল্পের পাশাপাশি ভৌগোলিক বৈচিত্র্য এবং পরিষেবা খাতের উন্নয়ন এই বিষয়গুলোও সামনে আসতে পারে। আমাদের ইইউ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আরও বেশি রফতানির প্রক্রিয়াকে আরও সহজতর করতে হবে। কর্তৃপক্ষকে শুধু সম্ভাব্য রাজস্ব লাভের কথা বিবেচনা না করে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বা অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করার সুবিধাগুলো চিহ্নিত করতে হবে এবং এ বিষয়ে কাজ করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশ পাট খাত থেকে ১ বিলিয়ন ডলার আয় করে তবে বৈশ্বিক জলবায়ুু পরিবর্তন এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি বাড়ানোর বিবেচনায় এই শিল্পটি ৫-১০ বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারে। পাট এখন বিভিন্ন পণ্যে ব্যবহৃত হয় এবং বিশ্বের  দ্বিতীয় সর্বাধিক প্রাকৃতিক ফাইবার হয়ে উঠেছে। প্রতিযোগিতামূলক হতে আমাদের এই সেক্টরে আরও উদ্যোগ বিনিয়োগ করতে হবে। বাংলাদেশের মোট আবাদি জমির প্রায় ৭০ শতাংশ ধান উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় এবং দেশের গ্রামীণ শ্রমশক্তির প্রায় ৪৭ শতাংশ এ কাজে নিয়োজিত। আমাদের প্রযুক্তির ব্যবহার আরও বাড়াতে হবে, বেসরকারি খাতের গবেষণা ও উদ্ভাবন বাড়াতে হবে, ভালো কৃষি পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে, দেশের ফসল-পরবর্তী ক্ষমতা এবং ব্র্যান্ডের উন্নয়ন করতে হবে। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা রফতানি বহুমুখীকরণের কথা বলে আসছেন। ‘বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট সামিট’-এর অন্যতম একটি আলোচ্য বিষয় ছিল, যা দেশে এবং বিদেশে অব্যবহৃত ব্যবসায়িক সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগানোর জন্য নীতি এবং আইনি সংস্কারের গুরুত্ব পুনর্ব্যক্ত করেছে।

কার্যত, বাংলাদেশ রফতানি আয়ের জন্য বছরের পর বছর ধরে একটি খাতের ওপর নির্ভরশীল। এখন রফতানির ৮৪ শতাংশ তৈরি পোশাকের অংশ। অন্যান্য শিল্প ও উৎপাদন প্রবৃদ্ধির সঙ্গে কবে যুক্ত হবে তা কেউ জানে না। চামড়া ও জুতা, ফার্মাসিউটিক্যালস, সিরামিকস, আইটি ও সফটওয়্যার, পাটজাত পণ্য, হালকা প্রকৌশল পণ্য, হস্তশিল্প, হিমায়ত খাদ্য, কৃষিভিত্তিক আইটেম এবং আরও কয়েকটি খাতকে চিহ্নিত করা হয়েছে যা বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়াতে পারে। যেখানে বিশ্বের  অনেক দেশ সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে সে ক্ষেত্রে আমরা মহামারি চলাকালীন সময়েও সবকিছু চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি। সরকার প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছে এবং আশা করা যাচ্ছে ভবিষ্যতে তা আরও ছাড়িয়ে যাবে।

বাংলাদেশ ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধার্থে দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি এবং সমন্বিত অর্থনৈতিক চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য ২৩টি দেশের ওপর একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন করা হয়েছে। অন্য কথায়, একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমরা আমাদের সামনে আসতে পারে এমন যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশেষ মনোযোগ দিয়ে কাজ করছি। অন্যান্য সম্ভাব্য নন-গার্মেন্টস সেক্টরের সঙ্গে জড়িত উদ্যোক্তাদেরও তাদের পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে এবং তাদের রফতানি আয় বাড়াতে নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে। বৈশ্বিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে টেক্সটাইল পণ্যে বৈচিত্র্য আনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একই জিনিস সবসময় পছন্দ নাও হতে পারে। পোশাকের নকশা, রং সবকিছুই পরিবর্তন করতে হবে বাজারের নতুন নতুন চাহিদা অনুযায়ী। বিশ্ব পোশাকের বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। আমাদের এই বিষয়ে আরও মনোযোগ দিতে হবে। বিশ্ববাজারে পণ্যের চাহিদা বাড়াতে আমাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। পোশাক শিল্পের বিকাশ ও প্রবৃদ্ধিতে এবং বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে বেসরকারি খাত সর্বাগ্রে। তাই রফতানি বহুমুখীকরণে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। বেশিরভাগ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো নয়। যুক্তি দেওয়া হয়েছে কম বেতনের অদক্ষ শ্রমের প্রাপ্যতার ওপর নির্ভর করে এগুলো চলে। তবে কোনো দেশের রফতানির জন্য কোনো একটি উৎসের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হওয়া কখনোই ভালো নয়। বিশ্বব্যাপী একটি বিরাট প্রতিযোগিতা রয়েছে আমাদের এ বিষয়টি মনে রাখা উচিত।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ও টেকসই সমৃদ্ধির জন্য রফতানি পণ্যকে বহুমুখী করতে হবে। এটি করা সম্ভব হলে একদিকে এক পণ্যের ওপর নির্ভরতা কমবে, অন্যদিকে মোট রফতানি আয় বাড়বে। বাড়বে কর্মসংস্থান। উপকৃত হবে নারীরাও। বাংলাদেশের অর্থনীতি গত দুই বছরে ৭ দশমিক ৩ থেকে ৭ দশমিক ৯ শতাংশ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। এ সময়ে ২০ লাখেরও বেশি মানুষ শ্রমশক্তিতে যোগ হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে একটি স্থিতিশীল গতিতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। সরকার রফতানিপণ্য বহুমুখী করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে। রফতানি খাতে কর হার, কর আদায় পদ্ধতি ও বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা নিয়ে ব্যাপক পর্যালোচনা হওয়া উচিত। কারণ অনেক ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় উদ্যোগ রয়েছে। আবার গবেষণায়ও জোর দিতে হবে, যাতে নতুন পণ্য উদ্ভাবন করা যায়। একটি পণ্যের ওপর নির্ভর করে এগোনো যাবে না। রফতানির অন্যান্য খাতকে এগিয়ে নিতে সরকারের নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের মধ্যে রফতানি বাণিজ্যকে সীমাবদ্ধ না রেখে বিভিন্ন ধরনের পণ্য রফতানির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার কারণে বাংলাদেশি বিভিন্ন ধরনের পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন দেশে। বিশেষ করে খাদ্য ও কৃষিজাত শিল্পপণ্য রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ডের পণ্য আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাওয়ায় এর বাজার বিস্তৃতির উজ্জ্বল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে রফতানি পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং নতুন বাজার সৃষ্টির প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।