এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার: মানবসভ্যতার শুরু থেকে বর্তমানের সর্বাধুনিক সমাজব্যবস্থায় আসার এই সুদীর্ঘ যাত্রাপথে কোনো অঞ্চলের সামাজিক প্রগতিশীলতার মানদন্ড হিসেবে আমরা সাধারণত অবকাঠামোগত সমৃদ্ধিকেই প্রাধান্য দিয়ে এসেছি। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক প্রসারতা, কৃষি ও খাদ্যে স্বনির্ভরতা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত অগ্রসরতা, নগরায়ন, শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইত্যাদি বিবিধ বিষয়কে উপযুক্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী তাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা করে এসেছে প্রথম থেকেই। সময়ের সাথে সাথে বাস্তবতায় পরিনত হয়েছে আমাদের অনেক স্বপ্ন ও পরিকল্পনা। স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। বহু অপশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ রাষ্ট্রপরিচালনায় আজ আমরা পৃথিবীর বুকে একটি আত্মনির্ভর জনপদ হিসেবে নিজেদের দৃঢ় অবস্থান তৈরী করতে সক্ষম হয়েছি।
কিন্তু, ইতিহাসের মহাসিন্ধুতে ডুব দিলে দেখা যায় অতীতের বহু উন্নত সভ্যতা আজ কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। মায়ান, ইনকা, নেবাটিয়ান, রোমান সাম্রাজ্য, মিশরীয়, মেসোপোটেমিয়া ইত্যাদি সমৃদ্ধশালী প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসস্তূপ এখন শুধুমাত্রই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। প্রাকৃতিক কারনের বাইরেও বেশকিছু উন্নত সভ্যতা বিলুপ্ত হয়েছে জাতিগত কোন্দল ও যুদ্ধ-বিগ্রহে চরম ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে। বস্তুজগতে সবকিছুই নশ্বর, তাই শুধুমাত্র অবকাঠামোগত উন্নতির মাধ্যমে কোনো সভ্যতাই তার ব্যপ্তিকালকে খুব বেশি দীর্ঘায়িত করতে পারেনি। সুতরাং, আমাদের সময় হয়েছে নিজেদের সার্বিক উন্নয়নের পরিকল্পনাকে আরও প্রসারিত করে এমন একটি স্তরে উন্নীত করার, যা শুধুমাত্র অবকাঠামোগত বা স্থাপনাসর্বস্ব হবে না। তা হবে মানবিক, অসাম্প্রদায়িক, প্রাকৃতিক ও মানসিক দূষণমুক্ত, যুক্তি ও বিজ্ঞানমনষ্ক, অবাধ সাংস্কৃতিক পরিবেশ সম্পন্ন এবং অবশ্যই সম্পূর্ণরূপে আত্মনির্ভর।
হ্যাঁ, ঠিক এমন একটি পরম স্বপ্ন বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যেই গোড়াপত্তন হয় পাবনা ডেভেলপম্যান্ট ফাউন্ডেশনের। দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কর্তব্যরত পাবনা জেলার প্রায় সকল কৃতী, মেধাবী, প্রজ্ঞাশীল ও আন্তরিক মানুষগুলোর সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এই সংগঠনের সদস্য হিসেবে আরও সম্পৃক্ত হয়েছেন জেলার বিভিন্ন ব্যবসায়ী, আইনজীবী, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ ও শিক্ষক সহ সামরিক ও বেসামরিক বহু পেশাজীবি মানুষেরা। আমি নিজেও একজন গর্বিত সদস্য। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাপুরুষ ও সভাপতি হিসেবে আমরা পেয়েছি বীর মুক্তিযোদ্ধা, পাবনার সূর্যসন্তান, বাংলাদেশ সরকারের ২২তম মহামান্য রাষ্ট্রপতি জনাব মো: সাহাবুদ্দিন চুপপু মহোদয়কে। অনাগত প্রজন্মকে একটি নিরাপদ, সুন্দর ও সুস্থ ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা দিতে বর্তমান সমাজব্যবস্থার কিছু মৌলিক পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে এই সংগঠনের সদস্যরা পাবনা জেলার সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে নিরলস কাজ করে চলেছেন। তাঁদের উদারনৈতিক ও সমমনা মানসিকতার কারণে যে কোনো সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক কার্যক্রম পরিচালনায়, এমনকি- উন্নয়ন কার্যক্রমেও তাদের প্রদত্ত অনুদানের মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থ আমাদেরকে একদিকে যেমন সমালোচনার উর্ধ্বে রেখেছে, অন্যদিকে আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় কার্যক্রমগুলো কাঙ্খিত সফলতার সাথে সম্পন্ন করতে সক্ষম হচ্ছি। এটাই আমাদের প্রানশক্তি।
ঐতিহ্যবাহী চলনবিল, পদ্মা, যমুনা, ইছামতি, বড়াল, চিকনাই, ফুলজোর, হুরাসাগর প্রভৃতি নদীবিধৌত, উর্বর কৃষিভিত্তিক সবুজ শ্যামলীমা, সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও অবারিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাদেরকে পাবনাবাসী হিসেবে বিশেষায়িত করে। প্রাচীনকাল থেকেই শিক্ষা, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি, নাট্যকলা, সংগীত, ব্যবসা-বাণিজ্য ও রাজনীতির ক্ষেত্রে আমাদের নিজস্ব একটি ঐতিহ্য আছে। বায়ান্নর ভাষাআন্দোলন থেকে শুরু করে ৬৬’র ৬ দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে রয়েছে আমাদের অনন্য সাধারণ ভূমিকা। দেশের ইতিহাসের প্রতিটি পর্বেই আমাদের এই পাবনা জেলার নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে। সেই মর্যাদার কথা মাথায় রেখে নিজেদের দ্বায়িত্বশীলতাকে আরও সুদূরপ্রসারী করার সময় এসেছে এখন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আমরা সকল পাবনাবাসী অশেষ ঋণী হয়ে আছি। দেশের প্রতিটি অঞ্চলের মতো তিনি পাবনাকেও বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, নগরবাড়ি রেলপথ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, টেক্সটাইল কলেজ, মেডিক্যাল কলেজসহ প্রায় সকলক্ষেত্রে উন্নয়ন করার জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা কর্তব্য। তাঁর যোগ্য নেতৃত্বে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত তৃণমূল পর্যায়ের ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যবৃন্দ থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরের জনপ্রতিনিধিদের নিরলস প্রচেষ্টার এই ধারাবাহিকতায় পাবনা জেলার প্রতিটি অঞ্চলের আরো উন্নয়ন হবে বলে আমাদের বিশ্বাস রয়েছে। কিন্তু, উন্নয়ন শুধু সরকারের একার দায়িত্ব নয়, এতে সকল নাগরিকেরই নিজস্ব কিছু ভূমিকা ও কর্তব্য রয়েছে। তাই শুধুমাত্র সরকারি ব্যবস্থাপনার মুখাপেক্ষী হয়ে না থেকে প্রতিটি নাগরিককে এই বস্তুনিষ্ঠ সার্বিক উন্নয়ন প্রকল্পের অংশীদার করাই পাবনা ডেভেলপম্যান্ট ফাউন্ডেশনের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য। অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের সন্তানদের মধ্যে নিজস্ব সংস্কৃতি, জাতি ও দেশের প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ তৈরি করাও দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের অন্যতম একটি অংশ। বিগত ১৪ বছরে শেখ হাসিনা সরকার প্রায় সকল ক্ষেত্রেই বিপুল উন্নয়ন করেছেন। আজ আমরা নিজেদের সক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল হতে শিখেছি। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন বাঙালি সারা পৃথিবীতে গৌরবের সাথে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাদের সেই গৌরবের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছেন। এখনও আরো অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। সেজন্যই চাই উন্নত মনের মানুষ গড়া, যারা হবে জন্মভূমি ও শেঁকড়ের প্রতি সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল।
তারুণ্যের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বলেছিলেন—‘চলে যাব, তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ/প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,/এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি/নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।/অবশেষে সব কাজ সেওে/আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে/করে যাব আশীর্বাদ,/তারপর হব ইতিহাস।’
কবির সেই স্বপ্নের পথ ধরে আমরাও স্বপ্ন দেখি এমন একটি প্রজন্মের, যারা হবে প্রকৃত অর্থেই স্বশিক্ষিত। যারা হবে উদারনৈতিক মননশীল, সংস্কৃতিপ্রাণ, যুক্তিনির্ভর, বিজ্ঞানমনষ্ক, দায়িত্বশীল, অসাম্প্রদায়িক, আত্মনির্ভরশীল, শারীরিক ও মানসিকভাবে সুগঠিত এবং দেশ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ। আমাদের পরিকল্পনাগুলোও তাই সেভাবেই সাজানো হচ্ছে। সরকারি কর্মসূচির পাশাপাশি সংগঠনের নিজস্ব প্রচেষ্টায় জেলার প্রতিটি শিক্ষাকেন্দ্রকে সাজিয়ে নিতে হবে যুগোপযোগী উপকরণ ও অনুষঙ্গে। গড়ে তুলতে হবে প্রযুক্তিগত শিক্ষার সঠিক ব্যবস্থা। সৃষ্টি করতে হবে শিল্পচর্চার উপযুক্ত পরিবেশ। এখন থেকেই পরিকল্পিত নগরায়ণ, নদ-নদীর নাব্য নিয়ন্ত্রণ ও সঠিক মাত্রায় বনায়নের মাধ্যমে সমগ্র জেলার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে পাবনাকে একটি সুপরিকল্পিত পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবারের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের উপযুক্ত বৃত্তি প্রদানের মাধ্যমে তাদের উন্নত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। পথশিশু, বাস্তুহারা অসহায় বয়ষ্ক মানুষজন ও শারীরিক প্রতিবন্দী মানুষদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে সেই সেবামূলক কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে শিক্ষার্থীদের। প্রতিটি উপজেলায় শিল্পকলাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে আমাদের লোকজ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধার ও বিকশিত করতে হবে। আমাদের চাই স্বয়ংসম্পূর্ণ ও বিশ্বমানের আইটি পার্ক, শিশুমনোবিকাশ কেন্দ্র, আধুনিক বিজ্ঞানাগার, গ্রামভিত্তিক গণপাঠাগার, উন্মুক্ত খেলার মাঠ, আধুনিক ব্যায়ামাগার, সুনিশ্চিত স্বাস্থ্যসেবা। দেশের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির উন্নয়নকল্পে গড়ে দিয়ে যেতে হবে কৃষি গবেষণাগার। চাই যথাযথ বিশ্বমানের যোগাযোগ ব্যবস্থা। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঈদ, দুর্গাপূজা, বড়োদিন ইত্যাদি অনুষ্ঠানকে সমান মর্যাদায় সকলের সমন্বিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে সামজিক উৎসবে পরিণত করতে হবে। আমাদের এই প্রয়োজন এখন অনিবার্য হয়ে পড়েছে। তাই একটি প্রাকৃতিক ও মানসিক দূষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে সংগঠনের সকল সদস্যই আজ নিবেদিতপ্রাণ। আজ যে স্বপ্নের বীজ পাবনা ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে পাবনা জেলার মাটিতে বোনা হলো, এটি সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে অচিরেই সেই অঙ্কুরিত শস্য দেশের প্রতিটি জেলায় এই স্বপ্নচাষের জোয়ার তুলবে। সেই প্রজন্মের হাত ধরেই হতে পারে এক নতুন বিশ্বায়নের। আগামীর সেই পৃথিবী হোক সাম্য ও ভাতৃত্ববাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত, একতাবদ্ধ ও বৈষম্যহীন। সেই পৃথিবী হবে সত্য, সুন্দর ও আলোকিত। লেখক: এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার: পুলিশ সুপার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।