লাভের গুড় যাচ্ছে ফড়িয়ার পেটে : ১৫ টাকার ঢ্যাঁড়শ যেভাবে ৫০

পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার বেতবাড়িয়া গ্রামের কৃষক মজিবর রহমান (৬৫) তার জমিতে উৎপাদিত ঢ্যাঁড়শ ১৫ টাকা কেজি দরে ব্যাপারীর (ব্যবসায়ী) কাছে বিক্রি করেছেন। কৃষক মজিবর রহমানের মতো শত শত কৃষক প্রতিদিন উপজেলার মুলাডুলি আমবাগান কাঁচামালের আড়তে ঢ্যাঁড়শ বিক্রি করেন। এ আড়ত থেকে প্রতিদিন ১৮-২০ টন ঢ্যাঁড়শ ট্রাকযোগে দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরের কাঁচামালের আড়তে যায়। কৃষকের বিক্রি করা ১৫ টাকা কেজি দরের ঢ্যাঁড়শ ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে বিক্রি হয় ৪০-৫০ টাকা কেজি। কৃষকের কাছ থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে মধ্যস্বত্বভোগীরা কেজিপ্রতি ঢ্যাঁড়শে লুফে নেন ২৫ থেকে ৩৫ টাকা। এতে ঠকছেন কৃষক ও ভোক্তা দুজনই।

ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, এ উপজেলায় প্রায় ৪শ’ হেক্টর জমিতে ঢ্যাঁড়শের আবাদ হয়েছে। মুলাডুলি ও সলিমপুর ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি ঢ্যাঁড়শের চাষ হয়। এছাড়া উপজেলায় মুলাডুলি আমবাগানে কাঁচামালের আড়ত রয়েছে। এ আড়তে ঈশ্বরদীসহ পার্শ্ববর্তী পাঁচ উপজেলার ঢ্যাঁড়শ বেচাকেনা হয়। এখান থেকে প্রতিদিন ট্রাকযোগে সারাদেশে সবজি সরবরাহ করা হয়।

বেতবাড়িয়া গ্রামের কৃষক মজিবর রহমান বলেন, এক কেজি ঢ্যাঁড়শ জমি থেকে দিনমজুর দিয়ে তুলে বাজারে গাড়ি ভাড়া করে আনতে খরচ হয়েছে ৫ টাকা। এই ঢ্যাঁড়শ আড়তে নিয়ে গেলে বিক্রি হয় ১৩-১৫ টাকা কেজি। সার, বীজ, কীটনাশকের দাম আকাশছোঁয়া। অথচ কৃষকরা ঢ্যাঁড়শের দাম পায় না। টেলিভিশনে দেখি ঢাকায় ঢ্যাঁড়শ বিক্রি হয় ৫০-৬০ টাকা কেজি। আমরা এখানে পাই ১৩-১৫ টাকা কেজি।

কৃষক আনারুল ইসলাম বলেন, মুলাডুলি আড়তে ভেন্ডি (ঢ্যাঁড়শ) নিয়ে এসেছিলাম। ১৩-১৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করলাম। ঢ্যাঁড়শের এখন যে বাজারদর তাতে কৃষকদের লাভ নেই। সার, কীটনাশক কিনতেই টাকা শেষ। এখানকার ঢ্যাঁড়শ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ৪০-৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। এতে মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভবান হলেও কৃষক ও ভোক্তাদের সবসময়ই ঠকতে হয়।

মুলাডুলি আমবাগান কাঁচামাল আড়তের ব্যাপারী (ব্যবসায়ী) আবু বক্কার বলেন, আজ ১৫-১৬ টাকা কেজিদরে ঢ্যাঁড়শ কিনেছি। এখান থেকে ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছাতে গাড়ি ভাড়া, খাজনা, বেচাকেনার লেবার, লোড-আনলোডের লেবার, ক্যারেট খরচ, ঢাকার আড়তদার কমিশনসহ প্রতি কেজি ঢ্যাঁড়সে খরচ হয় ৮ থেকে ৯ টাকা। এখান থেকে ১৫-১৬ টাকা কেজি ঢ্যাঁড়শ কিনলেও ঢাকার আড়তে পৌঁছানো পর্যন্ত খরচ পড়বে ২৫-২৬ টাকা। ঢাকার আড়তে পৌঁছানোর পর সেখানকার লেবার, আড়তদার খাজনা, ভ্যানভাড়াসহ আরও কিছু খরচ। আড়তদার তখন খুচরা ব্যবসায়ী ও ফড়িয়াদের কাছে ৩০-৩২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। পরে খুচরা ব্যবসায়ীরা তাদের ইচ্ছামতো ৪০-৬০ টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি করেন।

ব্যবসায়ী মোস্তফা কামাল বলেন, ঢ্যাঁড়শ ১৫ টাকা কেজি দরে কিনেছি। এটি ঢাকার কারওয়ান বাজারে পৌঁছাতে ২৪-২৫ টাকা পড়বে। সেখানকার আড়তদারদের খাজনা, ভ্যানভাড়া, লেবার খরচ সবমিলিয়ে খরচ হবে ৩০ টাকার মতো। তারা বিক্রি করবে ৩১-৩২ টাকা দরে। এরপর এগুলো খুচরা ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে ভোক্তাদের কিনতে হবে ৪০-৬০ কেজি দরে।

মুলাডুলি আমবাগান কাঁচামাল আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, উত্তরাঞ্চলের অন্যতম সর্ববৃহৎ কাঁচামালের আড়ত এটি। এখান থেকে সারাদেশে কাঁচামাল সরবরাহ করি। এখানে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ব্যাপারীরা (ব্যবসায়ীরা) দরদাম করে কিনে থাকেন। এক কেজি ঢ্যাঁড়শ ঢাকার উদ্দেশ্যে পাঠানোর জন্য কেনার পরপরই প্রতি কেজিতে খরচ বেড়ে যায় ৯-১০ টাকা। এ ঢ্যাঁড়শ ঢাকায় পৌঁছানোর পর সেখানেও প্রায় ৭-৮ টাকা খরচ হয়। সবমিলিয়ে প্রতি কেজিতে খরচ হয় ১৫-১৭ টাকা। ১৫ টাকা কেজি ঢ্যাঁড়শ কেনার পর ঢাকায় পাইকারি আড়তদার ফড়িয়াদের (খুচরা বিক্রেতা) কাছে বিক্রির আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এটির দাম দাঁড়ায় ৩০-৩২ টাকা। এরপর ফড়িয়ারা আড়ত থেকে কিনে নিয়ে তাদের ইচ্ছামতো দামে বিক্রি করেন। এটি যদি ঢাকার ফুটপাতের বাজারে বিক্রি হয় তাহলে ৪০-৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। আর যদি বড় কোনো কাঁচাবাজারে বিক্রি হয় সেখানে ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। ঢ্যাঁড়শ বিক্রি করে কৃষক বা আমাদের মতো আড়তদারদের খুব বেশি লাভ হয় না। বেশি লাভবান হন ফড়িয়ারা, যারা খুচরা দামে বিক্রি করেন।

ঢাকা কারওয়ান বাজারের খুরশিদের আড়তের কাঁচামাল ব্যবসায়ী মো. বাদশার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, মুলাডুলি থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত এক কেজি ঢ্যাঁড়শ পৌঁছাতে প্রায় ১০ টাকা খরচ হয়। ঢাকায় পৌঁছানোর পর এখানকার আড়তের কমিশন, লেবার খরচ, ভ্যানভাড়াসহ আরও ৫-৭ টাকা খরচ হয়। আড়তদাররা খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে ৩০-৩২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। পরে ফড়িয়া বা খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সাধারণ ভোক্তারা তাদের নির্ধারিত দামে কিনতে বাধ্য হন। এভাবে মুলাডুলি আড়তে ১৫ টাকা কেজি দরে কেনা ঢ্যাঁড়শ ঢাকার সাধারণ ভোক্তারা ৪০-৫০ টাকা কেজি দরে কেনেন।

মুলাডুলি ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা রুমানা ইয়াসমিন বলেন, উপজেলার সবচেয়ে বেশি ঢ্যাঁড়শের আবাদ হয় মুলাডুলি ইউনিয়নে। এক বিঘা জমিতে ঢ্যাঁড়শ আবাদ করতে ৩০-৩৫ হাজার টাকা খরচ হয়। জমি লিজ নিয়ে আবাদ করলে আরও ১০ হাজার টাকা বেশি খরচ হয়। অর্থাৎ এক বিঘা ঢ্যাঁড়শ আবাদের খরচ ৪০-৪৫ হাজার টাকা। ভালো ফলন হলে বিঘাপ্রতি এক লাখ টাকার বেশি ঢ্যাঁড়শ বিক্রি হয়। কৃষকরা যদি জমি থেকেই ঢ্যাঁড়শ সরাসরি বিপণন প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করতে পারতেন তাহলে তারা বেশি লাভবান হতেন।

ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মিতা সরকার বলেন, বাজারে কোনো পণ্যের সরবরাহ বেড়ে গেলে তার দাম কিছুটা কমে যায়। এখন ঢ্যাঁড়শের দাম কিছুটা কম। তবে মৌসুমের শুরুতেই কৃষকরা ঢ্যাঁড়শের ভালো দাম পেয়েছেন। এখন ঢ্যাঁড়শের দাম কম পেলেও সর্বোপরি ঢ্যাঁড়শ চাষে কৃষকরা লাভবান হয়েছেন। বাজার ব্যবস্থার আরও উন্নয়ন হলে কৃষকরা আরও বেশি লাভবান হবেন বলে আমি আশাবাদী।