বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাঙালিদের বসবাসে মিনি বাংলাদেশ গড়ে ওঠার খবর চোখে পড়ে। তবে এবার বাংলাদেশেও বিদেশিদের বসবাসের দেখা মিলেছে। পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পদ্মার তীরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ৫ হাজার রুশ নাগরিকের পদচারণায় এমন অভাবনীয় পরিবর্তন হয়েছে। স্থানীয় অর্থনীতিতেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। রাশিয়ানদের বসবাসের কারণেই তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটার প্রয়োজন পড়ছে। তাদের জীবনধারার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিছু পণ্যের প্রয়োজন দেখা দেয়। তাদের সেসব চাহিদা মেটাতেই রূপপুরের ব্যবসায়িক চিত্র পাল্টে যেতে শুরু করেছে। জানা গেছে, ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজের উদ্বোধন করেন। রাশিয়ার পরমাণু সংস্থা রোসাটোমের সহযোগিতায় রূপপুর প্রকল্পের কাজ চলছে। এই প্রকল্পে প্রায় ৫ হাজারেরও বেশি রাশিয়ান বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী ও কর্মকর্তা কাজ করছেন। প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে।
ইউরেনিয়ামের ঐতিহাসিক হস্তান্তরের মাধ্যমে বিশ্বের ৩৩তম দেশ হিসেবে পারমাণবিক শক্তির যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। পারমাণবিক জ্বালানি ফ্রেশ নিউক্লিয়ার ফুয়েল বা ইউরেনিয়ামের মালিক হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করল বাংলাদেশ। বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) বিকেল ৩টা ৫২ মিনিটে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনলাইন উপস্থিতিতে ঐতিহাসিক হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এ সময় ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি। হস্তান্তর উপলক্ষে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে আয়োজন করা হয় গ্রাজুয়েশন সেরিমনি। দুই দেশের সরকার প্রধানের অনুমতিতে সেখান পারমাণবিক জ্বালানির একটি নমুনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমানের হাতে হস্তান্তর করেন রুশ পরমাণু শক্তি করপোরেশন রোসাটমের মহাপরিচালক আলেক্সি লিখাচেভ। এটি হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হলো বাংলাদেশ।
প্রকল্পে প্রায় ৫ হাজারেরও বেশি রাশিয়ান বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী, কর্মকর্তা ও স্থানীয় কর্মচারীদের কর্মচাঞ্চল্যে বদলে যেতে শুরু করেছে রূপপুর এলাকার দৃশ্যপট। এখানকার বাজারঘাট, দোকানপাট রেস্তোরাঁয় লেগেছে বদলে যাওয়া হাওয়া। বাংলা ভাষার পাশাপাশি চলছে রাশিয়ান ভাষারও প্রচলন শুরু হয়েছে। সাইনবোর্ডগুলোতে বাংলা ইংরেজির পাশাপাশি রাশিয়ান ভাষাও লেখা আছে।
স্থানীয় ব্যবসায়িরা চাহিদা বিবেচনায় নিজেদের ব্যবসাকে রূপান্তর করতে থাকেন। তারা রাশিয়ানদের রুচি ও চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে দোকানপাট সাজাতে শুরু করেছেন। সেলুন থেকে কাঁচা বাজার কিছুই বাদ যায়নি। সেলুন গড়ে তোলা সেলিম হোসেন জানান, রাশিয়ানদের রুচি ও চাহিদা বুঝে তিনি দোকানে সেবা দেন। আগের চেয়ে তিনি অনেক লাভবান বলে জানান। ব্যবসায়ী কোরবান আলী জানান, শুরু দিকে তাদের রুশ ভাষা বুঝতে সমস্যা হতো। তারা কেনা বেচার সুবিধার্থে রুশ ভাষার অতি প্রয়োজনীয় শব্দগুলো আয়ত্ব করেছেন। নিজেদের কেনাকাটার জন্য রাশিয়ানরাও কিছু বাংলা শব্দ শিখছেন। আরেক ব্যবসায়ী মানিক মিয়া জানান, শুরুতে সমস্যা হলেও এখন আর তাদের সমস্যা হচ্ছে না। সেলিনা পারভীন নামের এক ব্যবসায়ী জানান, তারাও কিছু করে রুশ ভাষা রপ্ত করেছেন। তাই এখন তারা নির্বিঘ্নে বেচাকেনা করতে পারছেন।
রাশিয়ান বেইজড্ একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করার আমিন আহমেদ জানান, তারা রেস্টুরেন্টে করে রাশিয়ানদের ভালো সাড়া পাচ্ছেন। তাদের খাবারের মেনু থেকে শুরু করে সব কিছুই তারা বুঝতে পারেন। কাঁচা বাজারে ও ফলের দোকানদার আরমান হোসেন জানান, রাশিয়ানদের সঙ্গে তাদের অনেকটা সখ্য গড়ে উঠেছে। অনেকদিন ধরে দেখায় ও ভাব বিনিময়ে তারা যেন এখন আপনজন।
পাবনা শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও বনলতা গ্রুপের অন্যতম স্বত্বাধিকারী মাসুদ রানা জানান, বছরখানেক আগে রাশিয়ানরা ছুটির সময়ে পাবনা শহরে বাজার করতে আসতেন। তারা মেগাশপ, ফাস্টফুডসহ ফলের দোকানে ভিড় করতেন। ইদানিং পাবনা শহরে তাদের পদচারণা কমেছে।
এর কারণ হিসেবে ঈশ্বরদীর বাসিন্দা মহসিন আলী জানান, রুপপুর এলাকার ব্যবসায়ীরাই রুশ নাগরিকদের চাহিদামত নানা পণ্যের পসরা সাজিয়েছেন। তাদের চাহিদামত কাঁচা তরকারিসহ সেলুন পর্যন্ত গড়ে উঠেছে। বেশ কিছু অভিজাত রেস্টুরেন্ট ও পার্লার পর্যন্ত গড়ে উঠেছে।
মহসনি আলী জানান, শুধু দোকান নয় রুশ ভাষা শেখার কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সেখানে দোভাষীর মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। দোকানপাটের ধরণ সম্বন্ধে বোঝানোর জন্য দোকানিরা বাংলা – ইংরেজির পাশাপাশি রুশ ভাষায় সাইনবোর্ড করেছেন। তাদের কর্মচারীরাও রুশ ভাষার বহুল ব্যবহৃত বা এখানে প্রয়োজনীয় শব্দগুলো আয়ত্ত্ব করে ফেলেছেন।
কয়েকজন রাশিয়ান নাগরিক কয়েকজন দোভাষীর মাধ্যমে জানান, তারা বাংলাদেশিদের আতিথিয়তায় চরম মুগ্ধ। বাংলাদেশ কুব সুন্দর দেশে বলে তারা মন্তব্য করেন। দায়িত্বশীলরাও উচ্ছ্বসিত চোখের সামনে বদলে যাওয়া রূপপুর দেখে।
পাবনা চেম্বার অব কমার্সের সিনিয়র সহ- সভাপতি আলী মর্তুজা বিশ্বাস সনি বলেন, রূপপুর প্রকল্প চালু হলে সারা দেশের মানুষ দীর্ঘমেয়াদে এর সুবিধা পাবেন।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক ড. শৌকত আকবর বলেন, এ দেশের মানুষ একটা প্রযুক্তি আত্মস্থ করেছেন। রুশ সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের বিনিময়ের সুযোগ হয়েছে। নিশ্চয় এসব বিষয়গুলো দেশকে সমৃদ্ধি করছে। স্থানীয় উন্নয়ন এখনই চোখে পড়ে। কোনো ওয়ার্কার এখন সাইকেলে আসে না। অধিকাংশের মোটরসাইকেল হয়েছে।
দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় একক প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি। আর্থিক বিবেচনায় এটি দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। সিংহভাগ খরচ (৯০ হাজার কোটি টাকার বেশি) রাশিয়া সরকারের ঋণসহায়তা থেকে নির্বাহ করা হচ্ছে। এটির নির্মাণ ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা রোসাটম এবং অ্যাটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট। কেন্দ্রটির জীবনকাল ৬০ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। এর প্রতিটি ইউনিটে প্রতি ১৮ মাসে একবার রিফুয়েলিং (পরমাণু জ্বালানি সরবরাহ) করা হবে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ আগামী বছর প্রথম ইউনিট থেকে জাতীয় গ্রিডে পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে চায়। একই বছর বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করার আশা করছে তারা।