দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দলীয় কর্মসূচি নিয়ে দীর্ঘ সময় সক্রিয় ছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কিংবা পল্টন ময়দানে। তথ্যপ্রযুক্তির প্রভাব আর সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন এসেছে মাঠকেন্দ্রিক সেই সভা-সমাবেশনির্ভর রাজনীতিতে। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন ডিজিটাল প্লাটফর্ম। এ মাধ্যমকে কাজে লাগাতে গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা থেকে শুরু করে নেতাকর্মীদের প্রশিক্ষণসহ নানা উদ্যোগ নিচ্ছে দল দুটি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি মাঠের পাশাপাশি ডিজিটাল প্লাটফর্মে নিজেদের শক্ত ভিত গড়ায় অধিক মনোযোগ দিয়েছে। অনলাইনে দলীয় প্রচারণার পাশাপাশি বিরোধী শিবিরের অপপ্রচার রোধে প্রশিক্ষিত কর্মী বাহিনী গড়ে তোলার কার্যক্রম পরিচালনা করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে একই উদ্দেশ্যে সাম্প্রতিক সময়ে ডিজিটাল প্লাটফর্মে নিজেদের উপস্থিতি বাড়িয়েছে বিএনপি। তবে বিএনপির বাইরে অনলাইনে যারা মানবাধিকারসহ নানা অসংগতি নিয়ে কথা বলছে, তাদের কর্মকাণ্ড দিনশেষে বিএনপির পক্ষে যায় বলে মনে করছেন দলটির নেতারা। যদিও ডিজিটাল কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে মামলার ভয়কেই বড় বাধা হিসেবে দেখছেন তারা।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো নেতাকর্মীদের প্রযুক্তিগত জ্ঞান সমৃদ্ধিতে কারিগরি সহায়তা প্রদান করে দলটির গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই)। এর পাশাপাশি সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, দলের পক্ষে প্রচারণা এবং বিরোধীদের বিভিন্ন ‘প্রোপাগান্ডা বা গুজব’ প্রতিরোধে প্রতিষ্ঠানটি কাজ করে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ডিজিটাল প্লাটফর্মে আওয়ামী লীগের সার্বিক কর্মকাণ্ড প্রসঙ্গে সিআরআই সমন্বয়ক তন্ময় আহমেদবলেন, ‘আমাদের পার্টির যেসব পাবলিক প্রোগ্রাম থাকে সেগুলো আমরা চেষ্টা করি ডিজিটাল প্লাটফর্মে নিয়ে আসতে। ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব—এসব জায়গায় আমরা প্রচার করি। এছাড়া বিভিন্ন মাধ্যম থেকে সরকার বা দলের বিরুদ্ধে যেসব প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হয়, তা আমাদের ফ্যাক্ট চেকারদের কাছে দেয়ার চেষ্টা করি। তারা এটা নিয়ে কাজ করে। পাশাপাশি আমরা নিজেরাও প্রচার করি যে ওই কন্টেন্টগুলো সত্যি নয়।’ তিনি বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি মহানগরের পাশাপাশি থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের প্রোগ্রামগুলো কাভার করার। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ, যুবলীগসহ বিভিন্ন ইউনিটকে নিয়ে ৯০টি বেশি কর্মশালা করেছি। তাছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে কর্মশালা করেছি। এসব কর্মশালায় প্রায় ১০ হাজার নেতাকর্মীকে আমরা কানেক্ট করেছি। তবে এখানে সবাই কাজ করবে না। এখান থেকে পাঁচ-ছয় হাজার নেতাকর্মী সবসময় কানেক্টেড থাকে। নেটওয়ার্ক বিল্ডিংয়ের ওপর আমরা বেশি জোর দিচ্ছি। যখন কোনো ধরনের অপপ্রচার হয়, তার বিরুদ্ধে কী করণীয় হবে সেটা আমাদের নেটওয়ার্কিংয়ের মধ্যমে কাজে লাগাই।’
ডিজিটাল প্লাটফর্মের রাজনীতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রস্তুতিতে সরব বিরোধী দল বিএনপি। দলটির নেতাকর্মীরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দিয়ে বিএনপি নিজেদের পলিসিগুলো মানুষের সামনে সহজেই হাজির করতে পারছে। এরই অংশ হিসেবে দলটি গত বছর গঠন করে মিডিয়া সেল। মিডিয়া সেলের একেকটি অংশ একেকভাবে কাজ করে। এছাড়া গবেষণা সেলের মাধ্যমেও অনলাইনে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় রয়েছে দলটি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘ডিজিটাল প্লাটফর্মের মাঠে নিজেদের অবস্থা দৃঢ় করার জন্য আমরা নিজেদের অবস্থান থেকে কাজ করছি। কোনো ধরনের মিথ্যা বা ভুয়া তথ্য কিংবা গুজব সোশ্যাল মিডিয়াসহ ডিজিটাল প্লাটফর্মে আমরা অনুমোদন দিই না। তবে সারা বিশ্ব এখন বিএনপির পক্ষে ও মানবাধিকারের পক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সোচ্চার। তারা নিজ নিজ উদ্যোগে এগুলো করে যাচ্ছে। তারা নিজেদের উদ্যোগে আগামী দিনে একটি মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বার্থে কাজগুলো করছে।’
আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপির খবর মানুষের নজরে বেশি থাকে দাবি করে তিনি বলেন, ‘ক্ষমতাসীনদের চেয়ে আমাদের ভিডিও বেশি লাইক ও শেয়ার হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায়ও তাই। এমনকি টিভি চ্যানেলগুলোয় বিএনপির কন্টেন্ট অনেক বেশি শেয়ার হচ্ছে, যেখানে আওয়ামী লীগের নিউজ শেয়ারের পরিমাণ খুবই কম।’
তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ডিজিটাল মাধ্যমের আওতায় নিয়ে আসতে এরই মধ্যে পরিকল্পনা নিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলটির ৭৭টি সাংগঠনিক ইউনিটে স্মার্ট কর্নার নির্মাণের লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে দলটি। এরই মধ্যে প্রাথমিকভাবে ২৩টি জেলা ইউনিটে স্মার্ট কর্নার স্থাপন করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সবুর বলেন, ‘আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের পার্টিকেও আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে জেলা ইউনিটে ডিজিটাল কর্নার স্থাপন করছি। পাশাপাশি আমাদের নিজস্ব প্রশিক্ষকদের মাধ্যমে নেতাকর্মীদেরও ডিজিটাল মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলার কার্যক্রম নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি।’
সিআরআই সমন্বয়ক তন্ময় আহমেদ জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের জেলা ইউনিট পর্যায়ে স্মার্ট কর্নার করা হয়েছে। সেখানে তারা নিজেদের ব্যবস্থাপনায় কম্পিউটার, রাউটার, ইন্টারসংযোগ ব্যবস্থা করছে। এসব স্মার্ট কর্নার হাব হিসেবে কাজ করবে। জেলা পর্যায়ে কাজ শেষ হওয়ার পর দলটি উপজেলা পর্যায়েও এমন উদ্যোগ নেবে। এজন্য জেলা, উপজেলা, থানা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায় থেকে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট তৈরির চেষ্টা চলছে। কোনো তৃতীয় পক্ষ বা এজেন্সিকে ব্যবহার করা হচ্ছে না।
এদিকে বিএনপির চলমান আন্দোলনগুলোয় অনলাইন প্লাটফর্ম বড় ভূমিকা রাখছে বলে মনে করছেন দলটির নেতাকর্মীরা। তাদের মতে, অনলাইনে খুব সহজে সারা দেশব্যাপী মানুষকে দলের বার্তা দেয়া যায়।
বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা বলেন, ‘রাজনীতির নতুন মাঠ এখন ডিজিটাল প্লাটফর্মকেন্দ্রিক। এরই অংশ হিসেবে আমরা মিডিয়া সেল গঠন করেছি। এরই মধ্যে বিএনপির মিডিয়া সেলের ফেসবুক পেজে আড়াই মিলিয়ন ফলোয়ারও পেয়েছি। আমাদের সাম্প্রতিক আন্দোলনগুলোয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শক্তিশালী ভূমিকা রাখছে। মিটিংয়ের জায়গাগুলোয় থ্রিজি, ফোরজি বন্ধ করে দেয়াটাই প্রমাণ করে সরকার ডিজিটাল মাধ্যমটাকে ভয় পাচ্ছে। মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করে জানতে চায় আমাদের দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা কী বলছেন, সামনের দিনে কী দিকনির্দেশনা আসছে। সুতরাং মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা আমরা পাচ্ছি। আমাদের পক্ষে যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন, আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। একটা বিষয় হলো আওয়ামী লীগের মতো আমাদের নিয়োগ দেয়া সম্ভব না। কারণ ওদের হয়ে যারা বলে বা লেখে, তারা ভাতা পায়। লাইক, কমেন্ট, শেয়ার দিলে টাকাপয়সা পায়। কিন্তু আমরা যদি বিরোধী দল নিয়েও লিখি, আমাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়ে যায়। অতএব দুটি প্রেক্ষাপট কিন্তু পুরোপুরি ভিন্ন।’ তিনি বলেন, ‘এখানে কে কী করছে, সে বিষয়ে সরকারের শক্ত নজর থাকে। এজন্য তারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করেছিল, যার নাম পরিবর্তন করে সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হচ্ছে। এ আইন ব্যবহার করে আমাদের প্রচুর নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তারা এখন পর্যন্ত এক লাখ ছেলেমেয়েকে নিয়োগ দিয়েছে, যারা সাইবার প্লাটফর্মটা চালাবে। সামনের দিকে সেটি আরো খারাপ দিকে যাবে বলেই আমার মনে হয়। আমরা যথেষ্ট সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করেছি।’
ডিজিটাল প্লাটফর্মে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল ফারুক খান বলেন, ‘নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আমাদের নির্বাচনী ইশতেহারে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দিই। সেই প্রতিশ্রুতি আমরা রক্ষা করেছি। এখন আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে এগিয়ে যাচ্ছি। সে লক্ষ্যে সরকার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আর আওয়ামী লীগও দল হিসেবে আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে। স্মার্ট কর্মী বাহিনী গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবে।’