পাবনার বেড়া ও সাঁথিয়ার স্কুল-কলেজের প্রায় সব শিক্ষার্থীর হাতে হাতে এসেছে মুঠোফোন। এই মুঠোফোন এখন মরণ নেশার মতো হয়ে গেছে শিশু কিশোরদের কাছে। গত দুই বছরে পরিবার থেকে মোবাইল ফোন কিনে না দেওয়ায় দুই উপজেলায় প্রায় ১০ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। মুঠোফোন বা মোবাইল ফোন হাতে পেয়ে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা অনলাইন গেমসে মেতে উঠেছে। এখন আবার অনলাইন গেমসের পর তারা অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। এসব শিক্ষার্থীর পাশাপাশি শ্রমজীবী, ভ্যানচালকসহ ছোট-বড় সব শ্রেণিপেশার মানুষও আসক্ত হয়ে পড়ছে অনলাইন জুয়া খেলায়। গ্রামগঞ্জসহ সবখানে জমজমাট হয়ে উঠেছে অনলাইন জুয়ার আসর।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের বিভিন্ন চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে আগ্রহ বাড়ছে অনলাইন জুয়ার প্রতি। সহজে প্রচুর টাকা উপার্জনের লোভে পড়ে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী ও বেকার যুবকসহ সব বয়সি দুই উপজেলার হাজারো মানুষ জুয়ায় জড়িয়ে পড়ছেন। গ্রামের শ্রমজীবী মানুষরা অনলাইন সম্পর্কে ভালো না বুঝলেও মোবাইলে লুডু দিয়ে জুয়া খেলছে। অনেকেই এনজিও এবং ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে, জমি বন্ধক রেখে জুয়া খেলে হচ্ছেন সর্বস্বান্ত। তরুণদের অনেকেই কৌতূহলবশত এ খেলা শুরু করার পরেই নেশায় পড়ে যাচ্ছেন। প্রথমে লাভবান হয়ে পরবর্তীতে লোভে পড়ে একপর্যায়ে খোয়াচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। জুয়ার কারণে বাড়ছে পারিবারিক অশান্তি ও দাম্পত্য কলহ। খেলার টাকা জোগাড় করতে এলাকায় মাদকসহ বাড়ছে অপরাধ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অ্যান্ড্রয়েড ফোনের মাধ্যমে মোস্টবেট, ওয়ান এক্সবেট, বেট উইনার, বেট৩৬৫, মেলবেট, লাইনবেট, জিটুইন, ক্রিকেক্স, প্যারিম্যাচ, এমসিডব্লিউসহ বিভিন্ন অ্যাপসে খেলা হচ্ছে এই জুয়া। এই অ্যাপসের মাধ্যমে ১০ টাকা থেকে শুরু করে যেকোনো পরিমাণ টাকা দিয়ে খেলা যায়। সব অ্যাপসের মধ্যে জুয়ার মাধ্যম হিসেবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে মোস্টবেট ও ওয়ান এক্সবেট অ্যাপস। এটা পরিচালনা করা হচ্ছে রাশিয়া, মালেয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে। এসব ওয়েবসাইট পরিচালনা করছে দেশের এজেন্টরা। জুয়ায় বিনিয়োগে মোটা অঙ্কের টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে। এটা খেলার সময় আশপাশের কেউ বুঝতে পারে না মোবাইলে গেম খেলছে নাকি জুয়া খেলছে। গ্রামগঞ্জের হাটবাজারসহ সব জায়গায় এজেন্টরা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা জমা দেওয়া এবং অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া হয়। এক হাজার টাকায় এজেন্টরা কমিশন নিচ্ছেন ৪০ টাকা। এই জুয়ায় যারা প্রথম দিকে আসক্ত হয় তারা প্রতারিত হচ্ছে ডলার বিক্রি করা একটি চক্রের হাতে।
সরেজমিনে কয়েকটি গ্রাম-পাড়া মহল্লায় ঘুরে দেখা যায়, শ্রমজীবী মানুষ জটলা ধরে বসে মোবাইলে লুডু খেলছে। তারা জানান, বর্ষায় কাজ কাম কম। তাই বসে লুডু খেলে সময় কাটাই। প্রকৃতপক্ষে তারা বাজি করে জুয়া খেলেন বলে জানান স্থানীয়রা।
বেড়া উপজেলার কৈটোলা গ্রামের ভুক্তভোগী এক অভিভাবক জানান, ‘আমার ছেলে নবম শ্রেণিতে পড়ে। মোবাইল কেনার বায়না ধরে স্কুলে যাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছিল। বাধ্য হয়ে মোবাইল কিনে দিয়ে বিপদে পড়েছি। নানা বাহানায় টাকা নেয়। পরে জানতে পারি মোবাইল দিয়ে নাকি সে জুয়া খেলে। ছেলের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ এই অনলাইন জুয়া নষ্ট করে দিচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনলাইনে জুয়া খেলে ক্ষতিগ্রস্ত এক যুবক বলেন, সি জি নামের একটি জুয়ার সঙ্গে যুক্ত হই। আমার গ্রুপে প্রায় ৩০ জনের মতো সদস্য হয়েছিল। প্রথমদিকে সবারই কিছু লাভ হয়। তিন মাসে আমার দুই লাখ টাকা খোয়া যায়। আমার টিমের প্রায় ৫০ লাখ টাকা লোকসান গেছে। আমি চাই আমার মতো কেউ যেন অনলাইন জুয়ার লোভে পড়ে সর্বস্বান্ত না হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক স্কুলশিক্ষার্থী জানান, ‘আমি প্রথমে ১৬০০ বিনিয়োগ করে প্রায় ২ হাজার টাকা পাই। এক মাসের মধ্যে প্রায় দশগুণ লাভ আমার অ্যাকাউন্টে জমা হয়। দুদিনের মধ্যে সব হেরে যাই। আমার সাইকেল ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করে বাড়িতে জানাই সাইকেল হারিয়ে গেছে। ধারের টাকা শোধ করতে শেষমেশ মোবাইলটাই বিক্রি করে দিতে হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নারী জানান, তার স্বামী ক্যাসিনোসহ অনলাইন জুয়া খেলায় আসক্ত হয়ে টাকার জন্য তাকে নির্যাতন করত। এ নিয়ে দাম্পত্য কলহের কারণে তিনি পারিবারিকভাবে তার স্বামীকে ডিভোর্স দিয়েছেন।
বেড়া মাসুমন্দিয়া জে জে বি ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক আলাউল হোসেন বলেন, শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ রক্ষায় অভিভাবকদের ভূমিকাই মুখ্য। শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে হবে শিক্ষকদের। জুয়ার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা এবং নৈতিক শিক্ষায় গুরুত্বারোপ করতে হবে। প্রশাসনেরও ব্যাপক নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন।
সাঁথিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম জানান, অনলাইন জুয়া শুধু সাঁথিয়ায় নয়, সারা দেশেই ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। জুয়ার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বেড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সবুর আলী বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের ভয়াবহ এই মোবাইল গেমসের নেশা থেকে সরিয়ে আনতে হলে প্রথমে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে এবং বেশি বই পড়ার আগ্রহ বাড়াতে হবে।’