এক সময় শতশত হাস্কিং মিলের (চালকল) মালিক, ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের পদচারণায় প্রাণবন্ত থাকতো পাবনার ঈশ্বরদীর আইকে রোড। তবে অটোরাইস মিলের দাপটে টিকতে না পেরে এসব চালকলের বেশিরভাগই এখন বন্ধ হয়ে গেছে। হাস্কিং মেশিনের শব্দ ও শ্রমিকদের কোলাহলে একসময় সরগরম থাকা এসব চালকল এখন নিস্তব্ধ হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। বেশকিছু মালিক চালকলের চাতাল গাড়ির গ্যারেজ ও অন্য কাজে ব্যবহারের জন্য ভাড়া দিয়েছেন। এসব হাস্কিং মিলে কর্মরত ১৫ থেকে ২০ হাজার শ্রমিক জীবিকার তাগিদে পেশা বদল করেছেন। উপজেলা চালকল মালিক গ্রুপ সূত্রে জানা যায়, ১০ বছর আগে ঈশ্বরদীতে ৬০০ হাস্কিং মিল চালু ছিল। এখন সর্বসাকুল্যে ১০০ হাস্কিং মিল চালু আছে। বাকি সব মিল বন্ধ হয়ে গেছে। যেসব হাস্কিং মিল চালু রয়েছে সেগুলোর অবস্থাও অত্যন্ত নাজুক। এসব মিলের মালিকরা ব্যাংক ঋণ ও ধারদেনায় জর্জরিত। এসব হাস্কিং মিলে ১৫ থেকে ২০ হাজার শ্রমিক কর্মরত ছিলেন। তারা অনেকেই পেশা বদল করে জীবিকানির্বাহ করছেন।
অন্যদিকে, উপজেলায় ১৭টি অটোরাইস মিল চালু রয়েছে। অটোরাইস মিলে উৎপাদিত চালের চেয়ে হাস্কিং মিলে উৎপাদন খরচ বেশি। মজুরি বৃদ্ধি ও শ্রমিক সংকট, ধান ও চালের দামে অসামঞ্জস্য হওয়াসহ নানা সমস্যার কারণে একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে হাস্কিং মিল। এসব চালকল মালিকদের প্রত্যাশা এলাকাভিত্তিক খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে কৃষকদের ধান উৎপাদনের প্রণোদনা- সুবিধার পাশাপাশি সরকার চালকল মালিকদের সমস্যা নিরসনে এগিয়ে আসবে।
ধান-চাল ব্যবসায়ীরা জানান, ১৯৯০ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চালের মোকাম হিসেবে পরিচিত ছিল ঈশ্বরদীর জয়নগর মোকাম। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ধান কিনে এখানকার হাস্কিং মিলাররা চাল উৎপাদন করতেন। পৌর শহরের ভেলুপাড়া থেকে পাকশী ইউনিয়নের রূপপুর পর্যন্ত আইকে রোডের দুইপাশে প্রায় সাত কিলোমিটার শুধু হাস্কিং মিল ও চাতাল ছিল।এছাড়া দাশুড়িয়া, আওতাপাড়া, ছিলিমপুর, মুলাডুলিসহ পুরো উপজেলাজুড়ে ৬০০ শতাধিক হাস্কিং মিল ছিল। এসব মিলে উৎপাদিত চাল বেচাকেনার জন্য গড়ে উঠেছিল শতাধিক রাইস এজেন্সি। এসব রাইস এজেন্সির মালিকরা ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেটসহ বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরে চাল সরবরাহ করা করতেন। ২০১০ সালের পর ঈশ্বরদীতে অটোরাইস মিল স্থাপন শুরুর পর ধীরে ধীরে বন্ধ হতে থাকে হাস্কিং মিল। মিল মালিক ও ব্যবসায়ীরা নানা কারণে লোকসানে পড়ে ঋণখেলাপি হয়ে অনেকেই নিঃস্ব হয়েছেন।
আইকে রোডের চরসাহাপুর এলাকার মিল মালিক রিয়াজুল ইসলাম মহলদার বলেন, অটোরাইস মিলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ঠিকে থাকতে না পেরেই হাস্কিং মিল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অনেক মিল মালিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মিল চালাতেন। ব্যবসায় লোকসানের ফলে তারা ব্যাংক ঋণ পরিশোধ না করতে পেরে ঋণখেলাপি হয়ে সবকিছু হারিয়েছেন। এসব মিলের লাখ লাখ টাকার যন্ত্রাংশ ও চাতাল ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
উপজেলার আথাইল শিমুলগ্রামের হাস্কিং মিল মালিক জাহাবুল ইসলাম বলেন, ক্রমাগত লোকসানের মুখে সাত বছর আগে মিল বন্ধ করে দিয়েছি। অটোরাইস মিলে উৎপাদন ব্যয় আর আমাদের হাস্কিং মিলের উৎপাদন ব্যয়ের মধ্যে পার্থক্য আকাশ পাতাল। অটোরাইস মিলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বাজারে টিকে থাকা সম্ভব না। এছাড়া শ্রমিক সংকট, শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধিসহ নানা সমস্যা তো আছেই।
চালকলের শ্রমিক আব্দুল আজিজ বলেন, একসময় আইকে রোডে চালকলে আমাদের মতো ১৫-২০ হাজার শ্রমিক কাজ করতো। ভোরে আজান দেওয়ার পর থেকে আইকে রোডে হাজার হাজার শ্রমিকের চলাচল শুরু হতো। এখন তো প্রায় সবই মিল বন্ধ হয়ে গেছে। এসব শ্রমিকরা পেশা বদল করেছেন। যেসব মিলে কাজ করি সেগুলোও মাঝেমধ্যে বন্ধ থাকে। তাই বাধ্য হয়ে আমরাও তখন অন্য কাজ করি।
ঈশ্বরদী উপজেলা চালকল মালিক গ্রুপের সভাপতি জুলমত হায়দার বলেন, ঈশ্বরদীতে একসময় ৬০০ হাস্কিং মিল ও চাতাল ছিল। এখন কমে ১০০ তে দাঁড়িয়েছে। লোকসানে পড়ে মিল মালিকরা পুঁজি হারিয়েছেন। অনেকেই ব্যাংক ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে না পেরে মিলের যন্ত্রাংশ ও জমি বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করেছেন।
তিনি বলেন, ধান কিনে চাল উৎপাদন করতে হাস্কিং মিলে আট থেকে ১০ দিন সময় লেগে যায়। আর অটোরাইস মিলে এক-দুইদিনের মধ্যে চাল উৎপাদন করে বাজারজাত করা যায়। তাদের উৎপাদন খরচও অনেক কম। তাই তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছে না।
পাবনা জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সভাপতি মো. ফজলুর রহমান মালিথা বলেন, ধান ও চালের দামে অসামঞ্জস্য, অটোরাইস মিলের চেয়ে হাস্কিং মিলের উৎপাদন খরচ বেশি। লোকসানের মুখে মিলাররা পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব ও ব্যাংকের ঋণখেলাপির কারণে হাস্কিং মিল ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া সরকারি খাদ্যগুদামে সরকারনির্ধারিত মূল্যে চাল সরবরাহ না করায় প্রায় পাঁচ শতাধিক চালকল কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এসব মালিকরা বাধ্য হয়ে মিল বন্ধ করে দিয়েছেন।