সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও নাটোর- উত্তরাঞ্চলের এই তিন জেলাজুড়ে বিস্তৃত দেশের মিঠা পানির বড় উৎস চলনবিল। এই বিশাল জলাভূমি একদিকে যেমন অন্যতম বড় শস্য ভাণ্ডার, তেমনই মাছেরও বড় জোগান আসে এখান থেকে। আর এখানকার হরেক প্রজাতির মাছ ঘিরে চলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় ভিন্ন এক কর্মব্যস্ততা। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে কর্মতৎপর হয়ে ওঠে এখানকার শুঁটকিপল্লির চাতালগুলো।
যুগের পর যুগ ধরে চলে আসা শুঁটকিপল্লিতে আজও আছে কর্মতৎপরতা। তবে মাছের সরবরাহ আগের মতো নেই। দেশের বৃহত্তম এই জলাভূমিতে সেই থইথই পানি আর নেই। কমে গেছে মাছও। এ অবস্থায় চলনবিলের বিভিন্ন মাছের আড়তে শুঁটকি মাছ শুকানোর ধুম এখন আগের চেয়ে অনেকটাই কম। এই জনপদের তিন জেলার ৯টি উপজেলার বিশেষত নারীদের দিনমান শ্রমে তৈরি চলনবিলের শুঁটকির সুনাম দেশ ছেড়ে বিদেশেও। কেননা এখানে দেশীয় পদ্ধতিতে শুঁটকি তৈরি করা হয়।
সৈয়দপুর, নিলফামারী ছাড়াও উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা ও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে যায় এসব শুঁটকি মাছ। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে উৎপাদিত চলনবিলের মাছের শুঁটকি ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, ওমান, বাহরাইন, দুবাই, ইরাক, কুয়েত, লিবিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ ২৫টি দেশে রপ্তানি হয়।
মহাজন কেবল মাছ কিনেই যেন দায়মুক্ত। তাড়াশের মহিষলুটি মাছের আড়ত, চাটমোহর উপজেলার বোয়ালমারী, সিংড়া বাজারসহ বিভিন্ন আড়ত থেকে মাছ কেনেন তারা। এরপর তা পৌঁছে যায় শুঁটকির চাতালে।
ভোরের আলো ফোটা থেকে শুরু হয় শ্রমিকদের কর্মযজ্ঞ। মাছে লবণ মাখানো, মাপজোখ করা, বহন করে মাচায় নেয়া, শুঁটকি উল্টে-পাল্টে নাড়া, শুঁটকি বাছাই করাসহ আরও কত কাজ! আর এসবই হয় নারীদের হাতে। এসব চাতালে শোল, বোয়াল, পুঁটি, খলশে, চেলা, টেংরা, বাতাসি, চিংড়ি, নলা, টাকি, বাইনসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ শুকিয়ে শুঁটকি করা হয়।
সরজমিনে দেখা যায়, হাটিকুমরুল-বনপাড়া হাইওয়ে রোডসংলগ্ন রাস্তার পাশের বিশাল এলাকাজুড়ে বিভিন্ন স্থানে বসে মাছ শুঁটকি করার চাতাল। আশপাশের গ্রামের নারীদের প্রাণ এই শুঁটকিপল্লি। চলনবিলের অধিকাংশ মাছ চলে আসে জেলা-উপজেলা সদরের আড়ত ও বাজারে। সেখান থেকে পাইকাররা শুঁটকির জন্য কিনে আনেন শত শত মণ মাছ।
তাড়াশ ঘরগ্রামের শুঁটকি চাতাল মালিক আবু জাফর বলেন, ‘বিল থেকে সাধারণত ডিসেম্বর মাসের দিকে বিল থেকে পানি নেমে যায়। আর সে সময়টা সামনে রেখেই মূলত চলনবিলে শুরু হয় মাছ ধরার ব্যাপক তৎপরতা। তবে এ বছর ডিসেম্বরের অনেক আগেই বিল থেকে পানি নেমে গেছে। মাছের ভরা মৌসুম এখন।
‘সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত চলবে মাছ সংগ্রহ। বর্ষার পানিতে চলনবিল অঞ্চলে যেসব মাছ বেড়ে ওঠে, সেসব মাছই ধরা চলে এ সময় পর্যন্ত। এখানে চাতালগুলোতে এ মৌসুমে প্রতিদিন শুঁটকি মাছের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫০ থেকে ৬০ মণ।’
আরেক চাতাল মালিক চাটমোহর হান্ডিয়ালের আলমাছ হোসেন বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় এ বছর মাছের উৎপাদন কম। ফলে বিল থেকে ধরা মাছের দামও তুলনামূলক বেশি। অথচ হিমশিম খাচ্ছি শুঁটকির দাম নিয়ে। শুঁটকির মোকামে সিন্ডিকেটের কারণে গত বছরের চেয়ে এ বছর মহাজনরা কম দামে শুঁটকি কিনছেন। ফলে লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে এই ব্যবসায়।’
তিনি বলেন, ‘প্রায় ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ২২টি জলাশয় ও ১৬টি নদীর সমন্বয়ে চলনবিলের প্রায় সাড়ে ৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে মাছ আহরণ করে শুঁটকি তৈরি হচ্ছে। গত বছর চলনবিলের বিভিন্ন পল্লি থেকে প্রায় ৮০০ টন শুঁটকি উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে।’
কয়েকজন শুঁটকি চাতাল মালিক জানান, এ বছর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল এক হাজার টন। কিন্তু চলনবিলে মাছ কম হওয়ায় গত বছরের তুলনায় এবার উৎপাদন কম হবে।
বিনায়েকপুর এলাকার আব্দুল গফুর জানান, ব্যক্তিমালিকানার জায়গা লিজ নিয়ে চালানো চলনবিল অঞ্চলের বিভিন্ন শুঁটকিপল্লিতে এখন কাজ করছেন কয়েকশ নারী। মাছের আকারভেদে শুঁটকির দাম হয় ভিন্ন ভিন্ন। ছোট আকারের মাছের শুঁটকি প্রতিমণ ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর বড় আকৃতির মাছের শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা মণ।
চাতাল শ্রমিক রোমেছা বেগম বলেন, ‘মহাজন নিয়মিত আমাদের মতো শ্রমিকদের খেতে দেন। সেজন্য কম মজুরিতে কাজ করেও খুশি আমরা। প্রতিদিন একজন নারী শ্রমিককে মজুরি দেয়া হয় ১৫০ টাকা আর পুরুষ শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ৩০০ টাকা।’
সলঙ্গার চাতাল মালিক দেলবার হোসেন জানান, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বাদাই জাল দিয়ে পোনা মাছ ধরায় চলনবিলে মৎস্য সংকট দেখা দিয়েছে। তাছাড়া খরা মৌসুমে অনেকেই পানি সেচ দিয়ে মাছ ধরে, যার কারণে বিলে মাছ কমে গেছে। বেশি দামে কেনা মাছ দিয়ে শুঁটকি করায় খরচও বেশি হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এ বছর সৈয়দপুর এলাকার শুঁটকি মহাজনদের ব্যবসা সিন্ডিকেটে পড়ে এ ব্যবসায় লোকসান খেয়েছি। এখন পর্যন্ত আমার এক লাখ ৫০ হাজার টাকা লোকসান রয়েছে।’
তাড়াশ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মশগুল আজাদ বলেন, ‘চলনবিলের মাছের শুঁটকির সুনাম ও চাহিদা দুটোই রয়েছে। ফলে আমরা এই শুঁটকির মান বৃদ্ধির জন্য চাতাল মালিকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। চাতাল মালিকরা অস্থায়ী হওয়ায় তাদের আর্থিক সহযোগিতা দেয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে এ বিষয়ে আমরা বিবেচনা করছি। আশা করি, এ অঞ্চলের শুঁটকি ব্যবসা আরও বহুদূর এগিয়ে যাবে। শুঁটকি স্বাস্থ্যসম্মতভাবে সংরক্ষণ করতে পারলে তা দেশের অর্থনীতিতেও ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে, তাতে সন্দেহ নেই।’