এখন শীতকাল। খেজুর ও পাটালি গুড় দিয়ে তৈরি দুধের পিঠা ও পায়েসের নাম শুনলেই জিহ্বায় পানি চলে আসে। খেজুর গুড় ও দুধের পিঠা-পায়েসের স্বাদ পায়নি এমন মানুষ বোধ করি নেই। এবারো শীত মৌসুমে জমে উঠেছে খেজুরের গুড় ও পাটালির বাজার। চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে বাজারে জোগানও প্রচুর। তবে এগুলো গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী প্রকৃত খেজুর গুড় নয়। চিনি, আখের গুড় ও আটা দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে এসব গুড়। এতে খেজুর গুড়ের মৌলিক স্বাদ গন্ধ হারিয়ে যাচ্ছে। প্রকৃত খেজুর গুড় চিনতে না পারায় এ ভেজাল গুড় কিনে প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা।
জানা যায়, তিন জেলার এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর সোডা ও ফিটকিরিসহ নানা রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে ভেজাল খেজুর গুড় ও পাটালি তৈরি করে দেদার হাটবাজারে বিক্রি করছে। এ অঞ্চলের বিভিন্ন উপজেলায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের একের পর এক অভিযান ও জেল জরিমানাতেও বন্ধ হচ্ছে না ভোজাল গুড় তৈরি ও বিক্রি।
পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও নাটোর জেলা কৃষি অধিফতর সূত্রে জানা যায়, এ তিন জেলায় প্রায় সোয়া লাখ খেজুর গাছ রয়েছে। পরিসংখ্যান মতে, প্রতিটি গাছ বছরের শীত মৌসুমে ১৮০ লিটার রস দেয়। প্রতি ১০ লিটার খেজুর রসে এক কেজি গুড় হয়। সেই হিসেবে ৫৬ হাজার ২৫০ মণ খাঁটি খেজুর গুড় উৎপাদন হওয়ার কথা। এতে প্রতি কেজি গুড় উৎপাদক পর্যায়ে গড়ে ৬০০ টাকা কেজি দরে বাজারে আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় প্রায় প্রায় ১৫৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
ব্যাপারীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, নাটোরে খেজুড়ের গুড় বেশি উৎপাদন হওয়ায় নাটোর সদর উপজেলার স্টেশন বাজার, বড়াইগ্রামের বনপাড়া বাজার, সিংড়া ও গুরুদাসপুরসহ চাঁচকৈর এলাকায় গড়ে উঠেছে আড়ত।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও নাটোর জেলার বিভিন্ন হাট-বাজার এবং পাইকারি মোকামে প্রতিদিন শত শত মণ গুড় ও পাটালি বেচাকেনা হয়। মোকামগুলোতে প্রতি মাসে ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকার ব্যবস্যা চলে। ব্যবসায়ীরা প্যাকেট ও টিনজাত পদ্ধতিতে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি করছে। বিদেশের বাজারে বাংলাদেশের খেজুরের গুড় ও পাটালির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
সিরাজগঞ্জের সলঙ্গার স্থানীয় কয়েকজন অভিযোগ করে বলেন, এখন হাটবাজারে খাঁটি খেজুর গুড় পাওয়া যায় না। এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীরা বাড়তি মুনাফার আশায় বাজার থেকে নিম্নমানের ঝোলা ও নরম গুড় অল্প দামে কিনে তাতে চিনি, রঙ, হাইড্রোজ, সোডা, ফিটকিরি, নানা রাসায়নিক পদার্থ ও ফ্লেভার মিশিয়ে কথিত খাঁটি খেজুরের গুড় ও পাটালি তৈরি করে স্থানীয় হাট-বাজারসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠাচ্ছে। পাবনার চাটমোহর, নাটোরের গুরুদাসপুর, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়াসহ রায়গঞ্জে প্রায় ৩৫০টি গুড় উৎপাদনকারী কারখানায় শত শত মণ ভেজাল গুড় তৈরি করা হচ্ছে।
নাটোরের গুরুদাসপুর পৌর এলাকার চাঁচকৈর বাজারে গুড় তৈরির কারখানায় দেখা যায়, বিভিন্ন বাজার থেকে কিনে আনা নিম্নমানের সামগ্রী মেঝেতে ফেলে গুঁড়ো করছেন শ্রমিকরা। পাশেই রয়েছে চিনির বস্তা। বিশেষ প্রক্রিয়ায় গুড়ের রঙ সাদা ও আকর্ষণীয় করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে এসব ব্যবসায়ীরা।
সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার বড় গুড়ের মোকাম রানীরহাট ও নওগাঁ হাটে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মানভেদে প্রতি কেজি গুড় খুচরা বাজারে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা এবং ঝোলা গুড় ৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
নওগাঁ হাটে গুড় বিক্রি করতে আসা গুড় উৎপাদনকারী আশরাফ আলী, আব্দুল খালেকসহ অনেকেই জানান, শীতকাল শুরুর আগে থেকেই গাছ মালিকদের সাথে টাকার বিনিময়ে অথবা রস কিংবা গুড়ের ভাগ দেয়ার চুক্তিতে প্রতিটি খেজুর গাছের জন্য ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা দিয়ে থাকেন। প্রতি কেজি গুড় উৎপাদনে খরচ হয় জ্বালানি-মজুরিসহ প্রায় ১৫০ টাকা। আর খাঁটি গুড় উৎপাদনে খরচ হয় গড়ে ৭০০ থেকে সাড়ে ৭০০ টাকা। তাই উৎপাদন খরচ পুষিয়ে নিতে ১০ লিটার খেজুর রসে এক কেজি চিনি ও পাঁচ কেজি আখের গুড় মেশান। তারা জানান, চিনি ও হাইড্রোজমুক্ত গুড়ের রঙ হয় কালো। তাতে প্রকৃত স্বাদ-গন্ধ অটুট থাকে। এ গুড় প্রতি কেজি কমপক্ষে ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হয়।
বড়াইগ্রামের বনপাড়ার আড়তদার পীযূষ জানান, বনপাড়া বাজারে সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার হাটে খেজুর গুড় কিনতে আসে সিরাজগঞ্জ, ফেনী, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকার ব্যাপারী। প্রতি সপ্তাহে বড়াইগ্রামের আড়ত থেকে অন্তত ৬০ হাজার কেজি গুড় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ হয়। তবে সব খরচ বাদে তাদের কেজি প্রতি গড়ে দুই-তিন টাকা লাভ থাকে বলে দাবি করেন পিযূষ।
ঢাকা থেকে আসা পাইকার তাহের মিয়া ও বগুড়া থেকে আসা কদ্দুস আলী ব্যাপারী জানান, খেজুর গুড়ের সেই ঐতিহ্য আর নেই। প্রান্তিক পর্যায়ের মৌসুমি গুড় উৎপাদনকারী ও মহাজন সবাই ইচ্ছাকৃতভাবেই ক্ষতিকর রাসায়নিকদ্রব্য মিশিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছেন।
তাড়াশ উপজেলার গুলটাহাটের গাছি জব্বার শেখ জানান, গত কার্তিক মাস থেকে তিনি ১০০টি গাছ চুক্তিভিত্তিক নিয়ে গুড় তৈরি করছেন। ক্রেতাদের অর্ডারে প্রতি সপ্তাহে তিনি ৩০ থেকে ৩৫ কেজি গুড় বিক্রি করছেন। অগ্রিম অর্ডারে প্রতি কেজি খাঁটি গুড় ৮৫০ টাকা দরে বিক্রি করছেন।
এ ব্যাপারে বেড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: ফাতেমা তুজ জান্নাত জানান, খেজুর গুড়ে চিনি, আখের গুড়, আটা, হাইড্রোজ, সোডা, রঙ, ফিটকিরিসহ রাসায়নিক পদার্থ মেশানোর কারণে কিডনি ড্যামেজ, খাদ্যনালীতে ক্যান্সার ও লিভারে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।