ভুয়া পশু চিকিৎসকদের প্রতারণায় সর্বসান্ত খামারিরা, পাবনায় গরু হত্যার বিচার দাবীতে মামলা

পাবনায় ভুয়া পশু চিকিৎসকদের প্রতারণায় সর্বস্ব হারাচ্ছেন প্রান্তিক গো খামারীরা। পশু চিকিৎসায় কোন ধরণের অনুমোদন ছাড়াই পশু পালনের জন্য যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে কয়েকদিনের প্রশিক্ষণ নিয়েই এসব ভুয়া পশু চিকিৎসক লিখছেন ব্যবস্থাপত্র,পুশ করছেন এন্টিবায়োটিক ইনজেকশনও। সম্প্রতি পাবনার চাটমোহর উপজেলার হান্ডিয়াল ইউনিয়নে ক্ষতিগ্রস্থ এক খামারি মামলা দায়ের করলে, জানা গেছে প্রতারণার ভয়াবহ চিত্র। এসব সিন্ডিকেটের সাথে উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের কর্মকর্তাদের যোগসাজশের প্রমাণও মিলেছে।
পাবনার চাটমোহর উপজেলার হান্ডিয়াল ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য তোজাম্মেল হক জানান, জগন্নাথপুর গ্রামের হতদরিদ্র কৃষক ছাদেক আলীকে সরকারের সামাজিক নিরপত্তা কর্মসূচি থেকে একটি বকন গরু এনে দেন তারা। গরুটিকে ঘিরে স্বাবলম্বী হবার স্বপ্ন দেখেছিলেন ছাদেক। ধার দেনা করে পরম যতেœ পালিত গরুটি, গর্ভবতী অবস্থায় গত ১৯ জুন অসুস্থ হয়ে পড়লে, ডাকা হয় স্থানীয় পশু ডাক্তার হিসেবে পরিচিত রায়হান আলীকে। ছাদেকের অসহায়ত্বের সুযোগে দুই দিন ধরে কয়েক দফায় নানারকম ওষুধ ও মালিকের নিষেধ উপেক্ষা করে জোরপূর্বক ৪টি ইনজেকশান দেন রায়হান। তাতে অবস্থার অবনতি হলে পরদিন সার্জন সাজিয়ে আনেন চাটমোহর প্রাণিসম্পদ অফিসের উপসহকারী কর্মকর্তা একরামুল কবির তপন ও সুমন দত্তকে। চিকিৎসক না হয়ে, একরামও লিখেন ব্যবস্থাপত্র। আবারো দেয়া হয় ইনজেকশান। তাদের প্রতারণা ও ভুল চিকিৎসায় ২১ জুন রাতে মারা যায় ছাদেকের গরুটি।
ছাদেক আলী জানান, সন্তানের আদরে বড় করা গরু হারিয়ে দিশেহারা হয়ে বিচারের দাবিতে তিনি যান চাটমোহর উপজেলা প্রাণীসম্পদ দপ্তরে। সেখানে সহযোগিতা না পেয়ে, অভিযোগ করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট। চাপে পড়ে তদন্তে বাধ্য হয় প্রাণিসম্পদ বিভাগ। উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের ভেটেনারি সার্জন ডা. জাহিদ আল হাসানের তদন্তে, গবাদিপশুর চিকিৎসায় রায়হান আলী, একরামুল কবিরের ভুল চিকিৎসা ও চিকিৎসা প্রদানে বৈধ সনদ ও অনুমোদন না থাকার প্রমাণ মেলে। এরপরও বিষয়টি ধামাচাপার চেষ্টা হওয়ায় তিনি বাংলাদেশ ভেটেনারি কাউন্সিল আইন, ২০১৯ এর ১৭/২৬/২৭/৩৮ ও ৪২০/৪২৯ ধারায় আদালতে মামলা দায়ের করেছেন।
ছাদেক আলী বলেন, আমরা মূর্খ মানুষ। কে ডাক্তার কে ডাক্তার না তা জানিনা। হান্ডিয়ালে গরুর ওষুধের দোকানদাররা সবাই চিকিৎসা করে। আমার গরুক রায়হান ভুল চিকিৎসা দেছে। প্রাণিসম্পদ অফিসের তপনও আইসে কয়ছে সে সার্জন। তারা ভুল চিকিৎসা দিয়ে আমার গরুক মাইরে ফেলিছে। প্রাণিসম্পদ অফিসে প্রথমে পাত্তা দেয় নাই, কইছে ঝামেলা করে লাভ নাই। আমি ইউএনও অফিসে যায়া কওয়ার পর তদন্ত করেছে, তখন শুনলাম রায়হান, তপন এরা সবাই নাকি ভুয়া ডাক্তার। আমি আমার গরু মারার বিচার চাই।
স্থানীয়রা জানান, গোখামারি অধ্যুষিত চাটমোহরে প্রশাসনের নাকের ডগায় দিনের পর দিন প্রকাশ্যে চিকিৎসার নামে প্রতারণা করে আসছে ভেটেনারি ওষুধ ব্যবসায়ীদের একাধিক সিন্ডিকেট। ক্ষতিগ্রস্থ হলেও তাদের দাপটে মুখ খোলার সাহস নেই গো খামারিদের।
হান্ডিয়াল ইউপির মাজগ্রামের নাসির উদ্দিন অভিযোগ করেন, কেবল রায়হানের ভুল চিকিৎসায় গত কয়েক মাসে তাদের এলাকায় ৬ টি গরু মারা গেছে। ওষুধের দোকানদার কোম্পানির লোক সবাই আইসে ডাক্তার পরিচয় দেয়। প্রাণিসম্পদ অফিসও আমাদের কয় নাই এরা ডাক্তার না। গরু মারার পর তারা তাড়াতাড়ি মাটি চাপা দেওয়ায়। কিছু কইলি তারা সবাই একজোট হয়ে ভয় দেহায়। ছাদেক ভয় না পায়ে মামলা করার পর জানিছি এরা সবাই চিটার।
একই গ্রামের জিল্লুর রহমান জানান, চলনবিল পাড়ের তাদের এলাকা ডেইরি শিল্প অধ্যুষিত। এ কারণে এখানে পশু ডাক্তারের প্রয়োজনও বেশী। এই সুযোগে এখানে সক্রিয় কয়েকটি ভুয়া ডাক্তার সিন্ডিকেট। সহজ সরল খামারিদের সাথে প্রতারণা করে গত এক বছরে অন্তত ২০টি গরু তারা হত্যা করেছে।
এদিকে, চিকিৎসা দেয়ার কথা স্বীকার করলেও নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন অভিযুক্ত ভুয়া ডাক্তার রায়হান। তিনি বলেন, জরুরী প্রয়োজনে ইনজেকশান দিয়েছি। তবে তা ভুল হয়নি। গুরুত্বর অবস্থায় খবর দেয়ায় গরু বাঁচানো যায়নি। চিকিৎসা দেয়ার অনুমোদন বা বৈধতার প্রশ্নে কোন সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।
চাটমোহর উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের উপসহকারী কর্মকর্তা একরামুল কবির বলেন, আমি ছাদেকের বাড়িতে সার্জন পরিচয়ে যাইনি। আমার এক বছরের ডিপ্লোমা করা আছে। ত্রিশ বছর ধরে চিকিৎসা দেই। অফিসের স্যারেরাও বিষয়টি জানেন। চিকিৎসা দিতে কেউ আমাকে নিষেধ করেনি।
তবে, রেজিস্টার্ড চিকিৎসক ছাড়া ব্যবস্থাপত্র দেয়ার সুযোগ জানিয়ে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আল মামুন হোসেন মন্ডল বলেন, রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের স্বল্পতা যুব উন্নয়নের প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেকেই চিকিৎসা দেন, এটি গুরুত্বর অপরাধ। আমরা ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে এসব ভুয়া চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। একরামুল কবির রেজিস্টার্ড চিকিৎসক নন। ভুয়া পরিচয়ে চিকিৎসা দিয়ে থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রতারণা এড়াতে গবাদিপশুর চিকিৎসায় স্থানীয় প্রাণিসম্পদ হাসপাতালে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়ার অনুরোধ জানান তিনি।