বেড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভুয়া বিল ভাউচারে সরকারি অর্থ লুটের হিড়িক

স্টাফ রিপোর্টার:

দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় ভেঙে পড়েছে পাবনার বেড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সেবা কার্যক্রম। হাসপাতাল ঘিরে প্রকাশ্যে সক্রিয় একাধিক দালাল চক্র, স্বাস্থ্যকর্মীদের বিরুদ্ধেও অবহেলা ও দুর্ব্যবহারের পাহাড়সম অভিযোগ। অর্থ কেলেঙ্কারিসহ সকল অভিযোগের তীর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফাতেমাতুজ জান্নাতের বিরুদ্ধে। দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ মিথ্যা দাবি করলে প্রমাণপত্র দেখানোর পর সদুত্তর দিতে পারেননি এ কর্মকর্তা।
হাসপাতাল ও বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া নথি বলছে, ২০২২ সালে ৮ সেপ্টেম্বর বেড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রে (এসি) পাখি ঢুকে পড়ায় সমস্যা দেখা দেয়। পাশ^বর্তী কাশীনাথপুর বাজারে আলিম রেফ্রিজারেটর ও ইলেকট্রনিক্সের মেকানিক আলিমকে ডেকে তা সারালে বিল হয় মাত্র ৫০০ টাকা। কিন্তু ঐ তারিখে আলিমের দোকানের ভাউচারে ২ টি এসি ও ৫ টি ফ্রিজ মেরামত খরচ দেখিয়ে ২০২৩ সালের ৬ জুন ২২ হাজার টাকা উত্তোলন করেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। যেখানে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফাতেমাতুজ জান্নাতের সাক্ষর রয়েছে। ঠিক তার এক মাস আগে ২০২২ সালের ৭ আগস্ট ঐ ৫টি ফ্রিজই পাশর্^বর্তী ফরিদপুর উপজেলার বনওয়ারীনগরের জে.কে. রেফ্রিজারেটর থেকে মেরামতের ভাউচার দেখিয়ে উত্তোলন করা হয়েছে ২০ হাজার টাকা। আবার ঐ বছরই মে মাসে একই দোকানের ভাউচারে দুটি এসির মেরামত দেখিয়ে উত্তোলন করা হয়েছে ১৮ হাজার টাকা। অথচ এই অস্বাভাবিক মেরামত খরচের বিষয়ে কিছুই জানেন না মেরামতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
কাশীনাথপুর বাজারের আলিম রেফ্রিজারেটর ও ইলেকট্রনিক্সের সত্ত্বাধিকারী আলিম বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ওই সময়ে আমি একটি এসি সার্ভিসিং করেছিলাম। এসির তেমন কোনো সমস্যা ছিলো না, একটি পাখি ভেতরে ঢুকে মারা যাওয়ায় এসি কাজ করছিলো না। আমি খুলে সেটি পরষ্কিার করে দিলে ভালো হয়ে যায়। সেদিন আমাকে ৫শত টাকা বিল দেয়া হয়েছিলো। যে ভাউচারে ২২ হাজার টাকার বিল তোলা হয়েছে, তাতে দেয়া আমার দোকানের নাম, আমার নাম ও মোবাইল নম্বর সবই ঠিক আছে। কিন্তু ভাউচারটি আমার নয়। এটি জাল ভাউচার। এ সময় তার মুল ভাউচারও দেখান মেকানিক আলিম।
একইভাবে বিল ও ভাউচারের বিষয়ে জানতে ফরিদপুর উপজেলার বনওয়ারীনগরের জে.কে রেফ্রিজারেটর সার্ভিস সেন্টারের সত্ত্বাধিকারী শরিফুল আলমের সাথে যোযোগ করলে তিনি বলেন, বেড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আমি বা আমার প্রতিষ্ঠানের কেউ কখনো কাজ করেনি। কোনো বিলও আমি করিনি। তাহলে আপনার ভাউচারে বিল কিভাবে হলো? জানতে চাইলে তিনি বলেন, যারা পরিচিত রয়েছেন, তারা অনেকেই বিভিন্ন সময় দু’একটি ভাউচার চায়। সম্পর্কের খাতিরে অনেককেই দিতে হয়। হয়তো সেভাবে নিয়েছিলো।
শুধু এসি বা ফ্রিজ মেরামতে নয়, করোনাকালে স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য বরাদ্দ হওয়া সম্মানীভাতাও নয়ছয়ের অভিযোগ উঠেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। বিধিবহির্ভূত প্রক্রিয়ায় ঐ সময়ে হাসপাতালের নাইটগার্ড, আনসার সদস্য, স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের স্বেচ্ছাসেবী দেখিয়ে জুলাই ২০২১ থেকে জানুয়ারী ২০২২ পর্যন্ত তুলে নেয়া হয়েছে প্রায় ৯ লক্ষ টাকা। সেখানে সবগুলো স্বেচ্ছাসেবীর বিল তোলা হয়েছে একজনের ভূয়া সাক্ষরেই। এমন অনিয়মেও সরাসরি সম্পৃক্ততার অভিযোগ হাসপাতালটির শীর্ষ কর্মকর্তা ফাতেমা তুজ জান্নাতের বিরুদ্ধে।
এ ব্যাপারে হাসপাতালে দায়িত্বরত আনসার সদস্য জুয়েল রানা বলেন, আমরা বেশ কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেছি। লাইন ঠিক করা, সিরিয়ালি লোক ঢুকানো সহ নানা কাজ করেছি। পরে বিলও পেয়েছি। সরকারি দায়িত্বে থেকে স্বেচ্ছাসেবী হতে পারেন কি না জানতে চাইলে এ আনসার সদস্য কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি।
হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই স্থানীয়দের। সরকারি এম্ব্যুলেন্স থাকলেও তার নাগাল পাননা সেবাপ্রার্থীরা। হাসপাতাল কম্পাউন্ডেই দেখা গেলো বেসরকারী এ্যাম্বুলেন্স। এক্সরে, ইসিজি ও সাধারণ প্যাথলজি পরীক্ষার আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকলেও রোগীদের পাঠানো হয় আশেপাশের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। সরকারের বিনামূল্যে দেয়া ওষুধ, সিরিঞ্জ, ব্যান্ডেজও কিনতে হয় বাড়তি দামে। প্রতিবাদ করলেই দুর্ব্যবহার, হয়রানির অভিযোগ স্বাস্থ্যকর্মীদের বিরুদ্ধে।
অভিযোগ অস্বীকার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফাতেমা তুজ জান্নাত বলেন, জনবল সংকটে প্রত্যাশিত সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। দুর্নীতির অভিযোগও অসত্য দাবি করেছেন। তবে ভুয়া বিল ভাউচার ও প্রমাণপত্র দেখালে তিনি বলেন, একই যন্ত্র একাধিকবার নষ্ট হতেই পারে। করোনায় লোকবল না পেয়ে হাসপাতালের কর্মীদের স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করানো হয়েছে। তাই তাদেরকেই বরাদ্দের ভাতা দেয়া হয়েছে।
পাবনার সিভিল সার্জন ডা. শহীদুল্লাহ দেওয়ান জানান, যেসব বিল ভাউচারের কথা বলা হচ্ছে তা আমার যোগদানের আগের। হাসপাতালের কর্মীদের স্বেচ্ছাসেবক ভাতা নেয়ার কোন সুযোগ নেই। এমন ঘটনা ঘটে থাকলে তা সুস্পষ্ট অনিয়ম। অভিযোগ সত্য হলে প্রয়োজনে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।