বিশ্বমানের হবে পাবনা মানসিক হাসপাতাল, বিদেশিদের পড়াশোনার সুযোগ

প্রায় ৬৮ বছর আগে একটি জমিদার বাড়িতে শুরু হয়েছিল পাবনা মানসিক হাসপাতালের কার্যক্রম। পরে হেমায়েতপুরে নেওয়া ৬০ শয্যার হাসপাতালটির বর্তমান শয্যা সংখ্যা ৫শ। দীর্ঘ এ সময়ে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি দেশের প্রধান এ মানসিক হাসপাতালটিতে। প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এবার যুক্ত করা হচ্ছে বিশ্বমানের সব সুযোগ-সুবিধা। থাকছে বিদেশিদের পড়াশোনা, গবেষণা ও চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ।

পাবনা মানসিক হাসপাতালকে ‘আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে রূপান্তর’ করতে চায় সরকার। এজন্য প্রাথমিকভাবে ১ হাজার ৪৬০ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয়প্রস্তাব করা হয়েছে। সম্পূর্ণ সরকারি খাত থেকে এ অর্থের সংস্থান করা হবে। দীর্ঘ সময়ে পুরোনো হাসপাতালটিতে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। নতুন কোনো ভবন, চিকিৎসার আধুনিক সরঞ্জামাদি, গবেষণাগার, ওষুধ সংরক্ষণের জন্য আধুনিক স্টোররুম কিংবা চিকিৎসক-কর্মচারীদের জন্য আবাসিক ভবন- এসবের কোনোটিই এ সময়ে নির্মিত হয়নি। এসব সমস্যার কথা বিবেচনা করেই স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। প্রকল্পের প্রস্তাবনা এরই মধ্যে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তর। জানুয়ারি ২০২৫ থেকে ডিসেম্বর ২০২৭ নাগাদ প্রকল্পটি পাবনা সদরের হেমায়েতপুরে বাস্তবায়ন করা হবে।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা অনুবিভাগ) নার্গিস খানম  বলেন, ‘নানা কারণে পাবনা মানসিক হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু সে তুলনায় এখানে আধুনিক চিকিৎসাসেবার সুবিধা নেই। কোনোরকমে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। এজন্য বিদ্যমান হাসপাতালটি বিশ্বমানের রূপ দিতে যা যা করা দরকার তাই করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘সব ধরনের আধুনিক চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করে রোগীদের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার সব প্রচেষ্টা করা হবে। এরই মধ্যে প্রকল্পের প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছি। আমরা আশা করবো কয়েকটি প্রকল্প মূল্যায়ন সভা শেষে এটা যথাযথভাবে অনুমোদন পাবে।’

নতুন অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে মানসিক হাসপাতাল পাবনাকে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত সুপরিকল্পিত মানের একটি ইনস্টিটিউটে উন্নীত করা, আন্তর্জাতিক পাবনা মানসিক হাসপাতালে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক স্নাতকোত্তর বিভিন্ন শাখায় গবেষণার সুযোগ তৈরি, পাঠ্যক্রম চালুর মাধ্যমে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নয়ন, মানসিক স্বাস্থ্যের বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা, গবেষণা ও প্রশিক্ষণ সুবিধা তৈরির মাধ্যমে যোগ্য এবং প্রশিক্ষিত জনবল গড়ে তোলা। হাসপাতালে নতুন ও কার্যকরী বিভিন্ন বিভাগ চালু এবং আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম স্থাপনের মাধ্যমে মানসিক ব্যাধি আরোগ্যে বহুমুখী আধুনিক পদ্ধতি প্রয়োগ করা প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, ডিসেম্বর ২০২৭ সালের মধ্যে হাসপাতালটি এক হাজার শয্যায় উন্নীত করা হবে। একই সঙ্গে ছয়তলা বিশিষ্ট একাডেমিক ভবন নির্মাণ, ৪ হাজার ৮৭ বর্গমিটার বিশিষ্ট পেশেন্ট অ্যাটেনডেন্ট হোস্টেল ভবন নির্মাণ, চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্মীদের আবাসনের জন্য ছয়তলা বিশিষ্ট চারটি ভবন নির্মাণ করা হবে। দুটি পুরুষ ও নারী হোস্টেল, চিকিৎসকদের একটি টি-ডরমিটরি ভবন, নার্সদের একটি টি-ডরমিটরি ও পাঁচতলা বিশিষ্ট একটি মাল্টি-ফাংশনাল ভবন নির্মাণ করা হবে। আরও থাকবে তিনতলা বিশিষ্ট একটি বিশেষায়িত শিশুদের জন্য বিদ্যালয় ভবন, ছয়তলা বিশিষ্ট একটি কেবিন ও সার্ভিস ব্লক।

পাবনা মানসিক হাসপাতাল সূত্র জানায়, পাবনার আধুনিক মানের হাসপাতালটিতে মানসিক রোগী এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রাখা হবে। এখানে আধুনিক মানের ওয়ার্ড, রোগী পুনর্বাসন সেন্টার, বৃত্তিমূলক সেন্টার, মিউজিক্যাল থেরাপি, চিত্রাঙ্কন সেন্টার, হাফওয়ে হাউজ, চাইল্ড সাইকিয়াট্রিক, অটিজম সেন্টার, সার্বক্ষণিক জরুরি বিভাগ, অ্যামিউজমেন্ট সেন্টার, গার্ডেনিং, সুইমিং, ক্যাটল ফার্মিং, সাইকিয়াট্রিক ট্রেনিং সেন্টার, আধুনিক প্যাথলজি বিভাগ, অর্গানোগ্রাম, লন্ড্রি প্ল্যান্ট, প্লে গ্রাউন্ড, ওয়াকওয়ে, আধুনিক স্টোর ভবন, আধুনিক প্রশাসনিক ভবন, বহির্বিভাগ, আধুনিক ডরমিটরি, চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসন সেন্টার, সাইকিয়াট্রিক বিশেষজ্ঞ তৈরির জন্য এমফিল, এসসিপিএস, এমডি ইত্যাদি কোর্স চালু।

জানা যায়, বিশ্বের যে কোনো দেশের রোগী এখানে চিকিৎসাসেবা নিতে ও ভর্তি হতে পারবে। হাসপাতালটিতে স্থাপন করা হবে মানসিক রোগের গবেষণাগার। বিশ্বের যে কোনো দেশের মানুষ এ হাসপাতালে গবেষণার সুযোগ পাবেন। মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা গবেষণা করে মানসিক রোগের ওপর ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করতে পারবেন। একই সঙ্গে মানসিক রোগের ওপর যেসব দেশি-বিদেশি শিক্ষার্থী লেখাপড়া করতে আগ্রহী তারা এ হাসপাতালেই লেখাপড়া করতে পারবে।

পাবনা মানসিক হাসপাতালের পরিচালক ডা. শাকফাত ওয়াহিদ বলেন, ‘দেশের ১৮ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। কিন্তু ৯০ শতাংশের বেশি রোগী হাসপাতালে যায় না। সামাজিক ভয়ে অনেকে স্বীকার করে না। এছাড়া কেউ আবার কবিরাজের কাছে চিকিৎসা নেন।’ তিনি বলেন, ‘রোগীর সংখ্যা বাড়লেও আমাদের দেশে বিশ্বমানের সেবা গড়ে ওঠেনি। এ কারণেই আমরা প্রকল্পটি হাতে নিয়েছি। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে পারলে অনেক আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনা হবে। বেশি রোগীকে আধুনিক চিকিৎসাসেবা দিয়ে দ্রুত সুস্থ করে তুলতে পারবো।’

১৯৫৭ সালে পাবনার ‘শীতলাই হাউজ’ নামক জমিদার বাড়িতে প্রথম একটি মানসিক হাসপাতাল অস্থায়ীভাবে স্থাপন করা হয়। পরবর্তীসময়ে ১৯৫৯ সালে জেলা শহর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে হেমায়েতপুরে ১৩২ দশমিক ২৫ একরে ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের দান করা একটি চত্বরে হাসপাতালটি স্থানান্তরিত হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে হাসপাতালটির শয্যা সংখ্যা ছিল ৬০টি। ২০০০ সালে হাসপাতালটি ৫০০ শয্যায় উন্নীত কর হয়। মোট শয্যার ২৮০টি নন-পেয়িং এবং ১২০টি পেয়িং আর প্রকল্পের অধীনে ১০০ শয্যা রয়েছে। হাসপাতালের মাদকাসক্তি নিরাময়সহ মোট ১৮টি ওয়ার্ড। এর মধ্যে পুরুষদের জন্য ১৩টি (১১টি নন-পেয়িং, দুটি পেয়িং) এবং নারীদের জন্য ৫টি (৪টি নন-পেয়িং, একটি পেয়িং ওয়ার্ড)।