বিপ্লবী জননেতা বাদশা ভাই স্মরণে: রণেশ মৈত্র

আমার বাল্যকাল থেকে প্রৌঢ়ত্ব পর্যন্ত আমিনুল ইসলাম বাদশা ছিলেন আমার অন্যতম সহকর্মী-সহযোদ্ধা। বাদশা ভাই আমার চেয়ে বয়সে বড়। তাঁর জন্ম তারিখ ৩০ এপ্রিল,১৯৩০। আমার জন্ম তারিখ ৪ অক্টোবর ১৯৩৩। রাজনীতিতেও তিনি আমার সিনিয়ার। তাঁর জন্ম পাবনা শহরে, আমার জন্ম গ্রামে। পাবনা শহরে স্থায়ী ভাবে চলে আসি ১৯৪৭ সালে। ভর্তি হই অষ্টম শ্রেণীতে তৎকালীন খ্যাতনামা গোপাল চন্দ্র ইনন্সিটিউশনে। তখনও বাদশা ভাইয়ের সাথে পরিচয়ের সুযোগ হয়নি।

পরিচয় ঠিকই হল,পাবনা শহরের রাজপথে। ১৯৪৮ সালের মার্চেও এক রৌদ্রজ্জল দিনে। রাজপথে ভাষা আন্দোলনের বিশাল মিছিলে। আসলে সেটা পরিচয় না বলে প্রথম সাক্ষাৎ বলাই শ্রেয় হবে। মিছিলে আসার উৎসাহ দেখে নাম ও কোন স্কুলের ছাত্র জানতে চাইলেন। বললাম। শুনে বললেন আমিতো ওই স্কুলেরই ছাত্র। ঠিক আছে বিকেলে ছাত্র ফেডারেশন অফিসে এসো, কথা হবে।

দিনকয়েক পরে এক সন্ধ্যায় গেলাম খেয়াঘাট রোডের ভাঙাচোরা টিনের ঘরে যেখানে ছাত্র ফেডারেশনের কার্যক্রম চলতো। বাদশা ভাই বললেন,সদস্য হতে। আমি বললাম ভেবে দেখি। এরপর তিনি গ্রেফতার হয়ে যান। ছাড়া পান ১৯৫০ সালে। মুক্তির পর থেকে তিনি প্রকাশ্যে কমিউনিস্ট পার্টি করতে শুরু করেন। আমি তখন পাবনা জেলা ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি। দিনের পর দিন দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে কখনো বাসায়, কখনো ছাত্র ইউনিয়ন অফিসে,কখনোবা রাজপথে। ইতিমধ্যেই আমরা কে সিনিয়ার কে জুনিয়ার ভুলে সহযোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছি। কারাগারের ভেতরেও তাই। যখনই পুলিশ গ্রেফতার করত, আটকাবস্থায় থানায় গিয়ে দেখতাম, বাদশা ভাই, প্রসাদ দা দিব্যি সেখানে বসে আছেন যেন আমারই অপেক্ষায়। এমনটাই চলতো ষাটের দশকের শেষ অবধি।

ন্যাপ গঠিত হল ১৯৫৭ সালের জুলাইয়ে। বাদশা ভাই পার্টির নির্দেশে ১৯৫৮ সালে ন্যাপে যোগ দিলেন। পরে ন্যাপের বারংবার অপ্রত্যাশিত ভ্ঙানে আলতাফ হোসেন,সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সঙ্গে গণতন্ত্রী পার্টি গঠন করেন।

বাদশা ভাইকে বিয়ের রাতেও পুলিশ তাকে রেহাই দেয় নি। বাসর ঘরে নববধুকে একলা রেখে তার বিয়ের রাত কাটল গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে। তারা তাকে ধরে নিয়ে যায়। কারণ পুলিশের ধারণা ছিল তিনি বিয়ে করছেন না। রাজনৈতিক কৌশলে বিয়ের নাটক সাজিয়ে গ্রেফতার এড়াচ্ছেন। অবশ্য তাদের এ ধারণা ছিল পুরোপুরি ভ্রমাত্মক।

বাদশা ভাই দুই শ্যালিকার বিয়ে দেন দুজন ন্যাপ নেতার সাথে। তার একজন সিরাজগঞ্জের সাইফুল ইসলাম, অন্যজন ঈশ্বরদীর আব্দুল হালিম চৌধুরী। তারা তিনজনই মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। তিনজনই পরে গণতন্ত্রী পার্টি গঠনে ভূমিকা পালন করেন। হালিম চৌধুরী আজও জীবিত, কিন্তু রাজনীতিতে তেমন সক্রিয় নন।

আমিনুল ইসলাম বাদশা সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন একেবারেই স্বেচ্ছায়। দেশে যখন প্রকাশ্য রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়ে গেল, তিনি তখন শহরের বাসনপট্টিতে ছোট্ট একটা দোকান ভাড়া নিয়ে সমৃদ্ধ একটি বইয়ের দোকান খুললেন। দোকানে রাখতেন মার্কসীয় রাজনীতির বই, প্রগতিশীল লেখক লেখিকাদের গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ এসব গ্রন্থ। মার্ক্সবাদে যেসব যুবক যুবতী আকৃষ্ট হতেন,তাদের জন্য প্রাথমিক রাজনীতি, অর্থনীতি শিক্ষার বই মজুদ রাখতেন। যাদের বই কিনে পড়ার সাধ্য ছিলনা তাদের দোকানে দাঁড়িয়ে বা বসে বই পড়ার সুযোগ দিতে কার্পণ্য করতেন না।

সাদাসিধে পোশাকের মানুষটিকে কখনো রিক্সায় চড়তে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। দূওে যেতে হলে বাসে যেতেন, শহরে সর্বত্র হেঁটেই চলাফেরা করতেন। জিজ্ঞেস করলে বলতেন, হেঁটে চলাফেরা মূলত দুটি কারণে,

এক, ডায়াবেটিক রোগীর উপকার হয়। দুই, পরিচিতজনের সাথে আলাপের সুযোগ হয়।
আসলেই পরিচিত কাউকে পেলে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে যেতেন বাদশা ভাই। অবস্থা এমন হয়েছিল দূর থেকে তাঁকে দেখলে অনেকে অন্য রাস্তা দিয়ে গন্তব্যে যেতেন, তাঁকে এড়ানোর জন্য। কারণ সকলের হাতে তো অত সময় থাকতো না।

বাদশা ভাই ভাষা আন্দোলনসহ এ দেশের সকল স্বাধীকার আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। রাজশাহী জেলে খাপড়া ওয়ার্ডে গুলিবিদ্ধ হয়ে, আমৃত্যু বয়ে বেরিয়েছেন পুলিশের বুলেট। তবে,তাঁর সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। আমি দাবী জানাবো,বাদশা ভাইসহ পাবনার সকল ভাষা সংগ্রামীদের বাড়ীর সামনের রাস্তা তাদের নামে করা হোক। জেলা পরিষদ, পৌরসভা খুব সহজেই কাজটি করতে পারে। সরকারের নিকট আবেদন, মুক্তিযোদ্ধার ন্যায় ভাষা সংগ্রামীদের তালিকাও অবিলম্বে গেজেট আকাওে প্রকাশ করা হোক। আমিনুল ইসলাম বাদশা ১৯৪৮ এর ভাষা সংগ্রামে যে বিশাল অবদান রেখেছেন,স্বীকার করতে দ্বিধা নেই আমরা পাবনাবাসী তা ভুলতে বসেছি। এই শুভ লগ্নে তাঁর বিদেহী আত্মাকে অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা জানাই।

লেখক : প্রয়াত রণেশ মৈত্র, সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত।