পাবনায় নিষিদ্ধ চায়না দুয়ারি জালে হুমকিতে প্রাকৃতিক মাছের উৎপাদন

পাবনায় নদী খাল বিলে চায়না দুয়ারি জালে পোনা ও ডিমওয়ালা মাছ নিধনের মহোৎসব চলছে। সুজানগর, বেড়া উপজেলায় পদ্মা যমুনা নদী, গাজনার বিল, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুরসহ পুরো চলনবিলাঞ্চলে বোয়াল, রুই, কাতলা, রিঠাসহ বিভিন্ন দেশি মাছের পোনা শিকার করে বাজারে প্রকাশ্যে বিক্রি চলছে। এতে মৎস্য ও জলজপ্রাণী যথেচ্ছভাবে নিধন হওয়ায় প্রাকৃতিক মাছ উৎপাদনে ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশংকা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

মৎস্যজীবী ও মৎস্য কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সারা দেশে চায়না দুয়ারির ব্যবহার শুরু হয় বছর পাঁচেক আগে। শুরুতে এই জাল চীন থেকে আমদানি করার কারণে এর নাম দেওয়া হয় চায়না দুয়ারি। তবে এখন এ ধরনের জাল দেশেই তৈরি হচ্ছে। সূক্ষ্ম জালে গোলাকৃতি বা চারকোনার রড পরিয়ে খোপ খোপ করে বিশেষ ধরনের ফাঁদ তৈরির মাধ্যমে এটি তৈরি করা হয়। এই ফাঁদ উচ্চতায় দেড় থেকে ২ ফুট এবং লম্বায় ৬০ থেকে ১০০ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে।

অল্প বা গভীর, যেকোনো পানিতে এই ফাঁদ পেতে রাখলে তাতে বড় মাছ, মাছের পোনা, এমনকি ডিম পর্যন্ত ধরা পড়ে। দ্রুত এই জাল মাছশিকারিদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পায়। তবে মাছের জন্য মারাত্মক হুমকি হওয়ায় মৎস্য অধিদপ্তর এই জাল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।

এই জাল দিয়ে পোনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন আকারের মাছ ধরায় উপজেলার নদী ও অন্য প্রাকৃতিক জলাশয় মাছশূন্য হয়ে পড়ছে। বাজারে পোনা বা ছোট আকারের দেশি মাছ মিললেও স্বাভাবিক আকারের দেশি মাছ মিলছে না বললেই চলে।

নিষিদ্ধ হলেও বেড়া উপজেলার প্রতিটি জালের দোকানেই এই জাল বিক্রি হচ্ছে। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাঝেমধ্যে অভিযান চালানো হয়। ফলে এগুলো বিক্রি হয় কিছুটা রাখঢাক করে। অবৈধ জাল ব্যবসায়ীরা ঢাকা থেকে কুরিয়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন পরিবহন সংস্থার মাধ্যমে এই জাল বেড়ায় এনে বিক্রি করছেন। গত ৫ জুলাই বেড়া উপজেলা প্রশাসন পৌর এলাকার সওদাগর কুরিয়ার সার্ভিস কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে ঢাকা থেকে আসা ১২ লাখ টাকা দামের ১০ বস্তা চায়না দুয়ারি জাল জব্দ করে পুড়িয়ে দেয়। এর আগে ১৯ জুন বেড়া বাসস্ট্যান্ড-সংলগ্ন করতোয়া কুরিয়ার সার্ভিসের কার্যালয়ে সাঁথিয়া উপজেলা প্রশাসন অভিযান চালিয়ে প্রায় ৩০ লাখ টাকা দামের এই জাল জব্দ করে পুড়িয়ে দেয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেড়া বাজারের চার-পাঁচজন জাল ব্যবসায়ী বলেন, শুধু বেড়া বাজারেই ১৫টির মতো জালের দোকান রয়েছে। এসব দোকানে একসময় কারেন্ট জাল বিক্রি হতো। এখন চায়না দুয়ারি বিক্রি হচ্ছে বেশি। ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের সঙ্গে দামদর ঠিক করার পর আড়ালে থাকা জায়গা থেকে নিষিদ্ধ এই জাল এনে বিক্রি করে থাকেন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বেড়া বাজার ছাড়াও উপজেলার মোহনগঞ্জ, রাকশা, আমিনপুর, নাকালিয়াসহ উপজেলাজুড়ে অর্ধশতাধিক জালের দোকান রয়েছে। আর এসব দোকানের প্রতিটিতেই সবচেয়ে বেশি যে জাল বিক্রি হচ্ছে তা হলো চায়না দুয়ারি।

উপজেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে বেড়া উপজেলায় আটটি নদ-নদীসহ প্রচুর প্রাকৃতিক খাল-বিল রয়েছে। এসব জলাশয় একসময় মাছে ভরপুর থাকলেও এখন তা অনেকটাই কমে গেছে। এরপরও অবশিষ্ট যা আছে, শত শত চায়না দুয়ারি জাল দিয়ে অবাধে মাছ ধরা হচ্ছে। স্বাভাবিক আকারের দেশি মাছ কমে যাওয়ায় নিষিদ্ধ এই জালে পোনা ও ছোট আকারের, এমনকি মাছের ডিম পর্যন্ত ধরা পড়ছে। মাছশিকারিরা এসব পোনা বাজারে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন।

বেড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন বলেন, ‘চায়না দুয়ারির কারণে দেশি মাছ হারিয়ে যেতে বসেছে। অফিসে লোকবল কম। এর মধ্যে বেশ কিছু অভিযান চালিয়ে এই জাল জব্দ করেছি। এই জাল ব্যবহারকারীরাও খুব ধুরন্ধর। এ জন্য এলাকাবাসীরও তাঁদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে আমাদের তথ্য দিতে হবে।’

এদিকে, বর্ষার পানি আসার শুরুতেই নিষিদ্ধ চায়না দুয়ারি জালে সয়লাব পুরো চলনবিল। নদী-নালা, খাল-বিলে জমে থাকা অল্প পানিতেই এই জালে ধরা পড়ছে ডিমভর্তি মা-মাছ ও শামুক-ঝিনুক, কাঁকড়া, সাপ, ব্যাঙ, কুইচাসহ বিলের জলজ প্রাণিকূল। আর এসব শিকারে মেতেছেন এক শ্রেণির অসাধু জেলেরা। এর ফলে মাছের স্বাভাবিক প্রজনন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি বিলের জীববৈচিত্র্য অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে।

চলনবিলপাড়ের পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া ও ফরিদপুর, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, নাটোরের বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর ও সিংড়া উপজেলার বাজারগুলোতে প্রকাশ্যে পোনা ও ডিমওয়ালা মাছ বিক্রি হচ্ছে। চলনবিলে বর্ষার নতুন পানি প্রবেশের সাথে সাথে এই অঞ্চলে এক শ্রেণীর অসাধু মানুষ ও জেলে কারেন্ট জাল, সোতি জাল, বাদাই জাল, ধর্মখরা, খেয়া জালের মত অতি সুক্ষ নিষিদ্ধ জাল দিয়ে পোনা ও ডিমওলা মা মাছ ছেঁকে তুলছে। এতে এ অঞ্চলের হারিয়ে যেতে বসেছে ৫০ প্রজাতির মিঠা পানির সুস্বাদু মাছ। এর মধ্যে বিভিন্ন নদী-নালা, খাল-বিল প্রবাহিত হয়ে চলনবিল অঞ্চলের ও এর শাখা নদীর পাড়ে পোনা বিক্রয়ের জন্য ছোট বড় প্রায় ২০০ আড়ত গড়ে উঠেছে। এসব আড়তে পোনা সংগ্রহের কাজ চলে বৈশাখ থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত।

স্থানীয়রা জানান, সারা রাত ধরে পোনা ও মা মাছ শিকার করা হয় এবং রাত পোহানোর আগেই বিলপাড়ে আগে থেকে প্রস্তুত থাকা যানবাহনে ওই মাছ চলে যায় বিভিন্ন আড়তে। প্রশাসন এসব দেখেও না দেখার ভান করছেন। দেড় দশক আগেও এ অঞ্চলের নদী-বিল ও জলাশয়ে প্রায় আড়াইশ প্রজাতির মিঠাপানির মাছের দেখা যেত। কিন্তু এখন এ অঞ্চলে দেশি প্রজাতির মিঠাপানির মাছের সেই জায়গা দখল করেছে চাষের মাছ।

বর্ষার পানি আসার সঙ্গে সঙ্গে চলনবিলে প্রচুর পরিমাণ মা মাছ ডিম ছাড়ার জন্য আসছে। এ সুযোগে এক শ্রেনীর অসাধু জেলে বিলের বিভিন্ন পয়েন্টে মাছ ধরার কারেন্ট জাল, বাদাই জালসহ বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে নির্বিচারে মা মাছ নিধন করছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন মৎস্যজীবী বলেন, বর্তমানে মা মাছের ডিম পাড়ার সময়। এ সময় রেণু ও পোনায় এলাকা ছেয়ে যায়। তা ছাড়া মাছগুলো নীরব থাকায় শিকারেও সুবিধা হয়। এতে কেউ তো বাধাও দিচ্ছে না।

চাটমোহর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. আব্দুল মতিন বলেন, আইনগতভাবে মা মাছ ও ৯ ইঞ্চির চেয়ে ছোট মাছ ধরা দন্ডনীয়। এ সময় তিন মাস ওই ধরনের মাছ শিকারের অনুমতি নেই। শীঘ্রই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে।

চাটমোহর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ রেদুয়ানুল হালিম জানান, অবৈধভাবে মাছ শিকার করায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *