বিশ্বে পাট থেকে উৎপাদিত সোনালী আঁশের দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ। এটি বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল। দেশ-বিদেশে পাটের ব্যাপক চাহিদাও রয়েছে। সরকার পাট রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করলেও কোনো কিছুই প্রান্তিক পাটচাষিদের মুখে হাসি ফোটাতে পারছে না। পাটের বাজার সিন্ডিকেট দখল করায় ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন পাবনার প্রান্তিক কৃষকরা। এখন হতাশাগ্রস্ত কৃষকরা পাট আবাদ ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
পাবনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর জেলার ৯ উপজেলায় ৪৫ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে পাট আবাদ হয়েছে। গত বছরে আবাদ হয়েছিল ৪০ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে। যা সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এখান থেকে ১ লাখ ৩০ টনের বেশি পাট উৎপাদন হওয়ার কথা রয়েছে।
পাবনার পুষ্পপাড়া ও দুবলিয়া হাটে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ভোরের আলো না ফুটতেই কৃষকরা আবাদি সোনালী আঁশ পাট নিয়ে হাঁটে আসছেন। ঘোড়ার গাড়ি, মহিষের গাড়ি, কেউবা করিমন, নসিমন ও ভ্যানে করে ছড়ানো আঁশ পাট নিয়ে অপেক্ষা করছেন। ভোর থেকে বৃষ্টি হওয়াতে পাট পলিথিন দিয়ে ডেকে রেখেছেন কৃষকরা। বেশি দামের আশায় বাজারে পাট নিয়ে এলেও হঠাৎ দরপতনে হতাশ তারা। গত হাটে পাটের সর্বোচ্চ দাম ২৬৫০ টাকা থাকলেও মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে বর্তমান ১৮০০ থেকে ২০০০ টাকা দরে নেমে এসেছে।
কৃষকরা বলছেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা পাটের দাম কমানোর জন্য অজুহাত খোঁজে। সামান্য বৃষ্টি বা হাঁটে পাটের আমদানি বেশি হলে সিন্ডিকেট করে পাট ক্রয় করে। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের বাজার ব্যবস্থা অনুযায়ী দাম দিয়ে পাট ক্রয় করা হচ্ছে। বেশি দাম দিয়ে কিনলে বড় বড় আড়তদাররা বেশি দাম দিতে চায় না। বাধ্য হয়ে এমন দামে কিনতে হয় তাদের।
পুষ্পপাড়া হাটে এসেছেন ভাঁড়ারা ইউনিয়নের হলুদবাড়িয়ার কৃষক জিলাল উদ্দিন। তিনি বলেন, এ বছর ৫/৭ বিঘা জমিতে পাটের আবাদ করেছি। ফলন মোটামুটি হয়েছে। বাজারে বিক্রি করতে এসে দেখি ১৭০০ টাকা করে ব্যবসাযীরা দাম বলছে। ১৮০০ টাকা হলে বেপারী কিনে নিচ্ছে। গত হাটেও পাট বিক্রি করেছি ২৬০০ টাকা করে। সামান্য বৃষ্টি বা অন্য অজুহাতে সিন্ডিকেট তৈরি করে ব্যবসায়ীরা পাট কম দামে কিনতেছে। চিন্তা করতেছি আর পাট আবাদ করব না। পাট বিক্রি করে খরচই উঠছে না। এ দামে পাট বিক্রি করে শ্রমিকের মজুরিও হয় না। পাট বিক্রি করতে আতাইকুলার মধুপুর থেকে এসেছেন দারোগ আলী। তিনি বলেন, রাত ২টার দিকে পুষ্পপাড়া হাটে পাট নিয়ে আসছি। ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে যে পাটের দাম রাতে ২৫০০ টাকা ছিল সেটি সকালে বৃষ্টি হওয়াতে কমিয়ে ২০০০ টাকায় নামিয়েছে। পুরো দেশ এখন সিন্ডিকেটের দখলে। তাদের জন্য আমরা ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছি না। মরে শেষ হয়ে যাচ্ছি। পথে বসা ছাড়া কোনো উপায় নেই। একেক হাঁটে যদি একেক দাম হয় তাহলে কীভাবে চলবে? সরকার যদি পাটের দাম নির্ধারণ করে দিতো তাহলে আমরা সঠিক দাম পেতাম। এখন লাভের গুঁড় পিপড়ায় খাচ্ছে। সদরের সাদুল্লাপুর ইউনিয়নের স্বরুপপুর গ্রামের কৃষক বাবর আলী বলেন, এক বিঘা পাট আবাদ করতে কমপক্ষে ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আবাদের মূল খরচই উঠছে না। পাট ধোয়ার একজন শ্রমিকের দাম ৮০০ টাকা করে। বর্তমানে সার বিষের দাম আকাশচুম্বী হওয়াতে লোকসান গুনতে হচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছি আমরা। কৃষকরা কষ্ট করে ফসল ফলায় আর বড় বড় ব্যবসায়ীরা লাভবান হয়। ভাবতেছি সামনের বছর আর পাট আবাদ করব না। তিল আবাদ করলেও ৪২০০ টাকা মণ করে বিক্রি করতে পারতাম।
আতাইকুলার ধর্মগ্রামের পাট ব্যবসায়ী সিদ্দিকুর রহমান বলেন, সরকার বিদেশ থেকে পাট আমদানি করায় কৃষক এবং ব্যবসায়ীরা পাটের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। পাবনার বেড়ার পাট ক্রয় কেন্দ্র বন্ধ হওয়াতে আমরা আরও বেশি বিপদে আছি। এসব পাট ক্রয় কেন্দ্র চালু করলে কৃষকরা এবং আমরা স্বস্তি পেতাম।
পাবনার পুষ্পপাড়া পাটের পাইকারি ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম বলেন, গত বছরে এই সময়ে প্রতি মণ পাট ৩ হাজার ২০০ থেকে ৩ হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। এবছর সবচেয়ে ভাল পাট আমরা ২৩শ থেকে ২৬শ টাকা করে কিনতেছি। আসলে দেশে সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। সিন্ডিকেটের জন্য দাম উঠানামা করে। সরকারের বিদেশ থেকে পাট আমদানি না করে রপ্তানির ব্যবস্থা করতে হবে। বিদেশের সঙ্গে শক্ত করে পাট রপ্তানির চুক্তি যদি সরকার করে তাহলে প্রান্তিক চাষিরাও লাভবান হবে আমরাও ঠিকমতো ব্যবসা পরিচালনা করতে পারব।
আতাইকুলার ব্যবসায়ী অশোক কুমার সরকার বলেন, আমরা পাবনার বিভিন্ন হাট থেকে পাট কিনে খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, কুষ্টিয়া, বগুড়াসহ বড় বড় আড়ৎদারদের কাছে পাইকারি বিক্রি করি। বড় বড় সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ না করলে এসব ছোট ছোট সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ হবে না। অনেক সময় বাজারে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে কৃষকরা দাম কম পাচ্ছে সেটা ঠিক আছে তবে সরকারের পক্ষ থেকে সঠিক বাজার দর ঠিক করা দরকার।
পাবনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জামাল উদ্দিন বলেন, এ বছর পাট আবাদের শুরুতেই বৃষ্টি হওয়াতে পাটের বাম্পার ফলন হয়েছে। এরপর পাট কাটার শুরুতে পানি না থাকায় কৃষকরা বিড়ম্বনার শিকার হলেও পরে বৃষ্টি হলে কৃষকরা পাট জাগ দিতে পারছে। যার জন্য এবার সব দিক থেকেই কৃষকরা সুবিধা পেয়েছে। শুরুতে পাটের বাজার দর ২৬০০ টাকায় কৃষকরা খুশি ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে ১৮০০- ২০০০ হাজারে দাম নামল কি জন্য সেটা বুঝে আসছে না। বাজারকে সঠিক রাখার দায়িত্ব কৃষি বিপণন কেন্দ্রের। দামের বিষয়ে প্রশাসন ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কাজ করলে ভালো হয়। তারপরও বাজারে যাতে কোনো অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করতে না পারে সে বিষয়ে প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলব।
পাবনা জেলা সিনিয়র কৃষি বিপণন (বাজার) কর্মকর্তা তারিকুল ইসলাম বলেন, গতবার অনেক ব্যবসায়ী ৩ হাজার টাকা করে পাট কিনে পরে ২ হাজার টাকা করে বিক্রি করাতে অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যে কারণে এবার পাট কেনার আগ্রহ কম। বৈশ্বিক বাজারের উপর নির্ভর করে তারা পাট কিনে থাকে। এরপরও এবার ২৩০০ টাকা করে পাট বিক্রি হচ্ছিল। তিনি আরও বলেন, এবার পাটও ভালো হয়নি। আবার পানির অভাবে কৃষক সেটা ঠিকমতো জাগ দিতে পারেনি। পাটের মান খারাপ হওয়ায় পাটের দাম কম যাচ্ছে। বাজারে সিন্ডিকেট আছে কিনা আমাদের জানা নেই। তবে আমরা নিয়মিত পাটের দর তদারকি করছি।