পণ্যের সরবরাহ ও দাম নিয়ন্ত্রণ করেন সিন্ডিকেটের লোকজন, কৌশলে হাতিয়ে নেন হাজার হাজার কোটি টাকা

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে দিশেহারা দেশের মানুষ। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতেই রোজগারের বড় একটি অংশ চলে যাচ্ছে। বাজারে এমন কোনো পণ্য নেই যার দাম নাগালের মধ্যে আছে। তাই মাস শেষ হওয়ার আগেই টান পড়ছে পকেটে। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে চাল, ডাল, আলু, তেল ও ডিম অন্যতম। এই পাঁচটি পণ্য ঘিরেই তৈরি হয়েছে সিন্ডিকেট। বছরজুড়ে এসব পণ্যের সরবরাহ ও দাম নিয়ন্ত্রণ করেন সিন্ডিকেটের লোকজন। কৌশলে হাতিয়ে নেন হাজার হাজার কোটি টাকা।

সরকারের বাজার মনিটরিং সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত তিন বছরে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে রান্নার তেলের দাম। লিটারে তেলের দাম বেড়েছে ৭৫ টাকা। ডালের দাম বেড়েছে ২৫ টাকা। সবচেয়ে কম বেড়েছে চালের দাম। তাও কেজিতে বেড়েছে ৫ থেকে ১০ টাকা। যদিও টিসিবির উল্লেখ করা মূল্যের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্য।

বাজারের দামের সঙ্গে টিসিবির মূল্য তালিকায় উল্লেখ করা দামের তারতম্যের বিষয়ে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মুখপাত্র হুমায়ুন কবির বলেন, টিসিবির প্রতিনিধিরা প্রতিদিন সকাল ৮ থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত বাজার পরিদর্শন করেন। রাজধানীর ১৫টির বেশি বাজারে গিয়ে পণ্যের সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ দামের এভারেজ করে প্রতিবেদন তৈরি করেন। তারপরও বাজারে পণ্যের দাম বাড়ে-কমে। তবে সেই দাম বাড়া বা কমার বিষয়টি আমাদের প্রতিবেদনে আসে না। এ কারণে দামে কিছু তারতম্য থাকতে পারে।

টিসিবির তথ্য মতে, ২০২০ সালের ২২ আগস্ট থেকে ২০২৩ সালের ২১ আগস্ট সময়ে সরু চালের দাম কেজিতে সর্বনিম্ন বেড়েছে চার টাকা। একই হারে বেড়েছে মোটা চালের দামও।টিসিবি বলছে, তিন ধরনের চালের মধ্যে ২০২০ সালের ২২ আগস্ট রাজধানীতে সবচেয়ে ভালো চিকন চাল কেজিতে বিক্রি হয়েছিল ৫৪ থেকে ৬৮ টাকায়। সেই চাল ২০২১ সালের একই সময়ে বিক্রি হয় ৬০ থেকে ৬৮ টাকায়। ২০২২ সালের একই সময়ে বিক্রি হয় ৬৫ থেকে ৮০ টাকা এবং বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭২ টাকা কেজিতে। যদিও টিসিবির এ দামের সঙ্গে বাস্তব চিত্রের মিল নেই। টিসিবির তথ্য মতে, মাঝারি মানের চাল (যেমন বিআর-২৮, বিআর ২৯ এবং পাইজাম চাল) ২০২০ সালের এই সময়ে বিক্রি হয়েছিল ৪৮ থেকে ৫৫ টাকা। ২০২১ সালে বিক্রি হয় ৫০ থেকে ৫৬ টাকা, ২০২২ সালে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা আর এখন বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি।

বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী  বলেন, উৎপাদন ও চাহিদা অনুযায়ী বাজারে চালের দাম বাড়ে কিংবা কমে। আমরা চালের দাম বাড়াই না। কারণ, দিন শেষে আমরাও ভোক্তা।

টিসিবির তথ্য মতে, ২০২০ সালের ২২ আগস্ট রাজধানীতে বড় মসুর ডাল প্রতি কেজি বিক্রি হয় ৬৫ থেকে ৭৫ টাকায়। এখন বিক্রি হচ্ছে ৯৫ থেকে ১০০ টাকা কেজিতে। যদিও খোলাবাজারে এ ডাল বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা। ছোট মসুর ডাল এখন বিক্রি হচ্ছে ১৪০টাকা কেজি। গত বছর একই সময় এ ডাল বিক্রি হয়েছিল ১২৫ টাকায়।

টিসিবির দাবি, বাজারে প্রতি কেজি ডায়মন্ড আলুর দাম ৩৬ থেকে ৪০ টাকা। বাস্তবে বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকায়। একই আলু ২০২০ সালের একই সময়ে বিক্রি হয় ৩৪ থেকে ৩৫ টাকায়, ২০২১ সালে বিক্রি হয় ২০ থেকে ২৫ টাকা, আর ২০২২ সালে বিক্রি হয় ২৬ থেকে ৩০ টাকা কেজি।

২০২০ সালে ১ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হয় ১০০ থেকে ১১০ টাকা। সেই তেল এখন বিক্রি হচ্ছে ১৭০ থেকে ১৭৫ টাকা। ২০২২ সালে এ তেলের দাম আরও বেশি ছিল। সে সময় লিটার প্রতি বোতলজাত তেলের দাম ছিল ১৮৫ থেকে ১৯০ টাকা। কিন্তু ২০২১ সালে ছিল ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা। সিটি গ্রুপের পরিচালক (অর্থ) বিশ্বজিৎ সাহা  বলেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়লে আমাদেরও তেলের দাম বাড়াতে হয়। বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমলে আমরাও কমে বিক্রি করতে পারি। আমরা ব্যবসায়ী হলেও দিন শেষে আমরাও ভোক্তা। সবসময় চেষ্টা করি তেলের দাম কমাতে।

বর্তমানে বাজারে ডিম বিক্রি হচ্ছে এক হালি ৫৮ থেকে ৬০ টাকা। টিসিবি বলছে, ফার্মের ডিম (লাল) হালি বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫৩ টাকা। তিন বছর আগে এক হালি ডিমের দাম ছিল ৩৩ থেকে ৩৫ টাকা। তার পরের বছর ২০২১ সালেও ছিল ৩৩ থেকে ৩৫ টাকা। ২০২২ সালে ছিল ৪০ থেকে ৫০ টাকা হালি।

ভোক্তাদের অভিযোগ, যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়াই ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তেল, চাল, ডাল ও আলুর দাম বাড়িয়েছেন। এর মাধ্যমে ভোক্তাদের পকেট কেটে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন তারা।

সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে কাজী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী জাহেদুল হাসান বলেছিলেন, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আমাদের চেয়ে ডিম ও মুরগির দাম কম। তবে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় বাংলাদেশের চেয়ে ডিমের দাম বেশি। আমরা যদি মুরগির খাবার ভারতের মতো কম দামে পেতাম তাহলে আমরাও কম দামে ডিম বিক্রি করতে পারতাম। তিনি বলেন, সবাই অভিযোগ করেন কর্পোরেট সিন্ডিকেট গত বছরের আগস্টের মতো এ বছরের আগস্ট মাসেও ডিমের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমরা দাম বাড়াইনি। ডিমের দাম আমাদের বাড়ানোর সুযোগ নেই।

ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, অসাধু ব্যবসায়ীরা এসব পণ্যের দাম সিন্ডিকেট করে বাড়িয়ে দিচ্ছেন। বাজার এখন কিছু অসাধু সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি। এজন্য সরকারের বাণিজ্য, কৃষি ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ও দায়ী। তারা সঠিকভাবে বাজার মনিটরিং করছে না। আবার কারসাজি চক্র চিহ্নিত হওয়ার পরও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান  বলেন, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর দাম অযৌক্তিকভাবে বাড়ানো হয়েছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে এই দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের ঠকাচ্ছে। সরকারের উচিত দ্রুত বাজার মনিটরিং করা, যারা বাজারে সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।

ক্যাবের সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, তেল, পেঁয়াজ, চাল ডাল সবকিছুর দাম মুনাফাখোররা বাড়িয়েছে। তারা সরকারের ছায়াতলে থেকে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের পকেট কাটছে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও জড়িত আছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, গরিব মানুষকে চালসহ খাদ্যপণ্য কিনতেই আয়ের বেশিরভাগ অর্থ খরচ করতে হয়। এর মধ্যে চাল কিনতেই আয়ের চার ভাগের এক ভাগ খরচ হয়। মাছ-মাংস কেনাসহ অন্যান্য খরচ সামলে নিতে হয় নির্দিষ্ট আয়ের মধ্যে। কয়েকদিন পরপর একেকটি পণ্য নিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়, আর দাম বাড়িয়ে সাধারণ ও সীমিত আয়ের মানুষের দুর্ভোগ বাড়ে। দাম বৃদ্ধির নেপথ্যে সিন্ডিকেট ও কর্পোরেট গ্রুপের কারসাজির কথা বারবার বলা হলেও শাস্তির দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে। আর সিন্ডিকেটের তৎপরতা বন্ধে বাজার ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা কাটাতে সংস্কারের কথা বলা হলেও কার্যকর কিছুই হচ্ছে না। যার ফল লুটে নিচ্ছে কিছু অসাধু চক্র।