প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশিদ
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী ন্যূনতম সময়ের মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন-পুনর্বাসন সম্পন্ন করে বঙ্গবন্ধু যে মুহূর্তে সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের একটি শক্তিশালী ভিত রচনা ও এর সার্বিক উন্নয়নে মনোনিবেশ করলেন, ঠিক তখনই মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত দেশি-বিদেশী চক্রের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রে সংঘটিত হয় বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মান্তিক, ১৫ই আগস্টের ট্র্যাজেডি। এরপর মোশতাক-জিয়া-এরশাদ-বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে এ দেশে মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যাখ্যাত সেই পাকিস্তানি সেনা-আমলা শাসন ও সাম্প্রদায়িক ধারার পুনঃপ্রত্যাবর্তন ঘটে। বাংলাদেশ পরিণত হয় ‘মিনি পাকিস্তানে’। হত্যা, ক্যু, পাল্টা ক্যু’র মাধ্যমে ক্ষমতা দখল বা দখলের চেষ্টা, ভোটাধিকারসহ জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ, নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়া, নিষিদ্ধ থাকা ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দলের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, সংবিধানের প্রস্তাবনাসহ চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে পরিবর্তন, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচারের পরিবর্তে তাদের রক্ষায় জারি করা হয় কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স’ (২৬শে সেপ্টেম্বর ১৯৭৫), তাদেরকে সরকারি আশ্রয়-প্রশ্রয়দান ও বাংলাদেশের বিদেশস্থ দূতাবাসে বিভিন্ন পদে আসীন করা, শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম-কে পাকিস্তানি পাসপোর্টে বাংলাদেশে আসার অনুমতি, তাকে এ দেশে বসবাস ও রাজনীতি করার সুযোগ দান (১৯৭৮), সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা (৭ই জুন ১৯৮৮), মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী করা, দুই যুদ্ধাপরাধী নিজামী ও মুজাহিদকে মন্ত্রী বানিয়ে (২০০১-২০০৬) মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তস্নাত বাংলাদেশের পতাকা তাদের হাতে তুলে দেয়া, ৭১-এর ঘাতক-খুনি ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা, অনেক সংগ্রামের বিনিময়ে অর্জিত নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ওপর দলীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার হীন চেষ্টায় চতুর্দশ সংশোধনী (১৬ই মে ২০০৪)-র মাধ্যমে এর মূল উদ্দেশ্য নস্যাৎ, ধর্মের নামাবলি পরিহিত উগ্র সন্ত্রাসী বা জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রতি পৃষ্ঠপোষকতা দান ইত্যাদি এদের শাসন আমলের বৈশিষ্ট্য।
১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জন্য যেমনি, তেমনি রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্য ছিল এক মহাবিপর্যয়কর ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বদানে যারা সক্ষম ছিলেন, তাঁরা হলেন তাঁরই ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচর জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার তিন মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায় একই খুনিচক্র তাঁদেরও বর্বরোচিতভাবে হত্যা করে।
৭৫-পরবর্তী আওয়ামী লীগের পুনর্গঠন কিছুতেই সহজসাধ্য ছিল না। রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৭৬ সালের ২৮শে জুলাই ‘রাজনৈতিক দলবিধি’ (পিপিআর) জারি করা হয়। বিচারপতি সায়েম তখন প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত থাকলেও, সরকারের নিয়ন্ত্রণ ছিল জেনারেল জিয়ার হাতে। পিপিআর-এর আওতায় রাজনৈতিক দলের জন্য নিবন্ধন লাভ আবশ্যকীয় করা হয়। আওয়ামী লীগ প্রথম যে আবেদনপত্র জমা দেয়, তাতে খসড়া গঠনতন্ত্রে ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ’ এ কথা উল্লেখ থাকায় তা অগ্রাহ্য হয়। নিবন্ধন লাভের স্বার্থে তা পরিবর্তন করে পুনরায় আবেদন করা হলে, ৪ঠা নভেম্বর ১৯৭৬ আওয়ামী লীগ দল হিসেবে সরকারের অনুমোদন পায়। এদিকে আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠিত করার প্রক্রিয়ায় দলের অভ্যন্তরে দেখা দেয় নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব।
১৯৮১ সালের ১৪-১৬ই ফেব্রুয়ারি মতিঝিল ইডেন হোটেলে অনুষ্ঠেয় দলের কাউন্সিলকে সামনে রেখে তা এমনই চরমরূপ লাভ করে যে, আওয়ামী লীগের ভাঙ্গন নিশ্চিত বলে তখন অনেকেই মনে করেন। পত্র-পত্রিকায় এই মর্মে শিরোনাম হয়। দলের এ-রকম এক সন্ধিক্ষণে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার আবির্ভাব ঘটে আওয়ামী লীগের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে। তখন দিল্লিতে তাঁর নির্বাসিত জীবন-যাপন। বয়স মাত্র ৩৩ বছর। তাঁর অনুপস্থিতিতেই দলের সর্বমহল বা পক্ষ সর্বসম্মতিক্রমে তাঁকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত করেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দীর্ঘ ৬ বছর নির্বাসিত জীবন যাপনে বাধ্য হয়ে অবশেষে ১৭ই মে ১৯৮১ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার প্রিয় স্বদেশে প্রত্যাবর্তন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, মানুষের ‘ভোট ও ভাতের’ অধিকার আদায় এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শুরু হয় তাঁর জীবনের এক সুদীর্ঘ সংগ্রাম। প্রধানত তাঁর নেতৃত্বেই এরশাদের দীর্ঘ সেনাশাসন (১৯৮২-১৯৯০)-এর অবসান ঘটে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিও তাঁর আন্দোলনের কারণেই সেদিন সফলতা লাভ করে। ২১ বছর ধরে বিরোধী দলে অবস্থান আর জেল-জুলুম-নির্যাতন ভোগ শেষে ১৯৯৬ সালের ১২ই জুনের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগের সরকার গঠন ও ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন তাঁরই নেতৃত্বের সাফল্য। মুখ্যত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের (২০০১-২০০৬) জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ভবিষ্যৎ নির্বাচনে তাদের পক্ষে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে গৃহীত বিশেষ পদক্ষেপ (সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অবসরগ্রহণের বয়স ৬৫ থেকে ৬৭ বছরে বৃদ্ধি) থেকে উদ্ভুত চরম সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ১/১১-এর সৃষ্টি। এরপর সেনানিয়ন্ত্রিত তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে (২০০৭-২০০৮) সেনাশাসনকে দীর্ঘায়িত করার নীলনকশা অনুযায়ী নেপথ্যের সেনাকর্মকর্তাদের নিয়ে তথাকথিত সংস্কার কর্মসূচির নামে বড় রাজনৈতিক দলে ভাঙ্গন সৃষ্টি, দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া বা ‘মাইনাস টু থিওরি’ ইত্যাদি উদ্যোগ বা ষড়যন্ত্র প্রধানত শেখ হাসিনার দৃঢ় ও সাহসী অবস্থানের কারণে নস্যাৎ হয়ে যায়। ফলে ২০০৮ সালের শেষের দিকে জাতীয় নির্বাচন দিতে নেপথ্য সেনাশাসকরা বাধ্য হয়। জাতি নতুন করে দীর্ঘ সেনাশাসনের হাত থেকে রক্ষা পায়। ২০১৪ সালেও বিএনপি-জামায়াত জোট জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিহত করার নামে প্রকারান্তরে যখন সেনাশাসন কায়েমের পক্ষে কাজ করছিল, সে সময়ও শেখ হাসিনা অত্যন্ত দৃঢ়তা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে ঐ ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিয়ে দেশে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হন।
১৯৮১ সালে দেশে প্রত্যাবর্তন করে আওয়ামী লীগের দায়িত্বভার বহনের পাশাপাশি চতুর্দিকে শেখ হাসিনাকে এক চরম বৈরী অবস্থা মোকাবিলা করতে হয়। এর ভেতর একটি ছিল সাম্প্রদায়িক জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ও তৎপরতা।
১৯৮০ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ধর্মচেতনাভিত্তিক আফগান তালেবানি শক্তির উত্থান, ওসামা-বিন লাদেনের নেতৃত্বে জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার সৃষ্টি, ২০০১ সালে আল-কায়েদার সন্ত্রাসী আক্রমণে আমেরিকার টুইন-টাওয়ার ধ্বংস বা ৯/১১-এর সৃষ্টি এবং বিশ্বব্যাপী ধর্ম ইসলামের নামে সৃষ্ট সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তাৎক্ষণিক যুদ্ধ ঘোষণা (War on Terror) বিশ্ব রাজনীতির মানচিত্রে বিভিন্ন মুসলিমপ্রধান দেশে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের উত্থান ঘটায়। ইরাক-সিরিয়া জুড়ে আইএস (ইসলামিক স্টেট)-এর উত্থান এক্ষেত্রে সর্বশেষ সংযোজন।
জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও নানা দিক থেকে অন্য দেশ থেকে এদেশ স্বতন্ত্র। এতদসত্ত্বেও উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রভাব থেকে এদেশ নিজকে মুক্ত রাখতে পারেনি। তবে, সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, ‘গণতন্ত্র’ ও ‘জাতীয়তাবাদী রাজনীতি’র নামে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন প্রথম বিএনপি সরকার (১৯৯১-১৯৯৬) এবং ২০০১ সালের নির্বাচন-উত্তর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে (২০০১-২০০৬) ইসলামের নামে জঙ্গি-সন্ত্রাসী গোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় মদদ ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ফলে দেশজুড়ে জামা’তুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), জাগ্রত মুসলিম জনতা, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হরকাত-উল-জিহাদ, হিজবুত তাহিরী, আল-জিহাদ বাংলাদেশ, আল্লাহর দল ব্রিগেড ইত্যাদি নামে অসংখ্য জঙ্গিগোষ্ঠী ও এদের নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ২১ বছর পর তাঁরই কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের পরপর এসব জঙ্গি-সন্ত্রাসী চক্র ঐ সরকার ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অসাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে একের পর এক হিংস্র ছোবল মারতে থাকে। যশোরে উদীচী সম্মেলনে (১৯৯১), খুলনার আহমাদিয়া মসজিদে (১৯৯৯), পল্টনে সিপিবি’র জনসভায় (২০০১), রমনার ১লা বৈশাখ অনুষ্ঠানে (২০০১), মকসুদপুরের বালিয়াচর খ্রিস্টান চার্চে (২০০১), নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে (২০০১), ময়মনসিংহে সিনেমা হলের অভ্যন্তরে (২০০২), বিচারকের বাড়িতে, জজের কোয়ার্টার্সে, আদালত প্রাঙ্গণে, আইনজীবী সমিতি ও ডিসি’র অফিসে বোমা হামলা (২০০৫), ৬৪টি জেলার মধ্যে ৬৩টি জেলায় একযোগে পাঁচশতাধিক বোমা বিস্ফোরণ (২০০৫), শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে কোটালীপাড়ায় তাঁর জনসভাস্থলে (২০০০) ৭০ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখা, একই উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু এভিন্যুতে তাঁর ‘শান্তির পক্ষে সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে’ গ্রেনেড হামলা (২১শে আগস্ট ২০০৪), ইতালি ও জার্মানির দুই নাগরিক যথাক্রমে সিজার তাবেল্লা ও হোসি কোনিও (২০১৫) হত্যা, মন্দিরের পুরোহিত যোগেশ্বর রায়-এর হত্যা (২০১৬), ঢাকার গুলশানে হোলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় ১৭ জন বিদেশীসহ ২০ জন জিম্মি ও ২ জন পুলিশ কর্মকর্তা হত্যার পৈশাচিক ঘটনা (১লা জুলাই ২০১৬), কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদের জামায়াতে জঙ্গি আক্রমণ ও পুলিশ হত্যা (৬ই জুলাই ২০১৬) ইত্যাদির মাধ্যমে কীভাবে এই জঙ্গি-সন্ত্রাসী গোষ্ঠী জনমনে চরম নিরাপত্তাহীনতা ও ভীতির রাজত্ব (Reign of Terror) কায়েম করতে উদ্যত হয়, তা সকলেরই জানা। স্মর্তব্য যে, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর ওপর নির্মিত ইউরিয়া ফার্টিলাইজার জেটিতে ২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ১০ ট্রাক অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদের এক বিশাল চালান আইন-শৃক্সখলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে।
বিএনপি-জামায়াত জোটের রাজনৈতিক সন্ত্রাসের শিকার হন খুলনা আওয়ামী লীগের সভাপতি এডভোকেট মঞ্জুরুল ইমাম (২০০৩), নাটোরের আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য মমতাজউদ্দিন আহমেদ (২০০৩), শ্রমিক নেতা ও আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টার (২০০৪), আওয়ামী লীগের সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া (২০০৫)-সহ দেশজুড়ে কয়েক হাজার আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী।
জীবনের শতভাগ ঝুঁকি নিয়ে হলেও শেখ হাসিনাকে উগ্র জঙ্গি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর অপতৎপরতা ও বিএনপি-জামায়াত জোটের রাজনৈতিক সন্ত্রাসকে সফলভাবে মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। শুধু তাই নয়, পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি (যারা ১৫ই আগস্টের পর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের আশ্রয় নিয়েছিল) তাদের এবং প্রধানত বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী, পাকহানাদার বাহিনীর দোসর, চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অনেককে ঘৃণ্য অপরাধের দায়ে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে এবং অনেক ক্ষেত্রে বিচারের সর্বোচ্চ রায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতেও ইতোমধ্যে সমর্থ হয়েছেন। একমাত্র শেখ হাসিনার দৃঢ় অবস্থান ও অঙ্গীকার এবং দেশবাসীর সাধারণ সমর্থনের কারণেই এদের বিচার সম্ভব হয়েছে।
১৯৮১ সাল থেকে শুরু করে আন্দোলন-সংগ্রামের দীর্ঘ পথে শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারবরণ, একাধিকবার গৃহে অন্তরীণ থাকা, প্রায় এক বছর তাঁর শেরে বাংলানগরের নির্জন কক্ষে সাব-জেলে কাটানো, মিথ্যা মামলায় বিশেষ আদালতে বিচারের সম্মুখীন হওয়া, হত্যার উদ্দেশে জনসভা স্থলে বিধ্বংসী বোমা পুতে রাখা, জনসভা স্থলের উদ্দেশ্যে যাত্রাকালে গাড়ি বহরে শত-শত রাউন্ড গুলি বর্ষন ও বহু লোককে হতাহত করা (চট্টগ্রাম, ২৪শে জানুয়ারি ১৯৮৮), ২৪ বার তাঁর নিজের প্রাণনাশের উদ্দেশে আক্রমণের চেষ্টা ইত্যাদি তাঁকে অতিক্রম করতে হয়েছে। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিন্যু’র তাঁর সমাবেশে প্রকাশ্য দিবালোকে গ্রেনেড হামলার প্রধান টার্গেট ছিলেন শেখ হাসিনা স্বয়ং। যদিও তিনি ঘটনাক্রমে প্রাণে বেঁচে যান, তবে নারী নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতা-কর্মী ঐ ঘটনায় প্রাণ হারান। অনেকে চিরদিনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করেন। তিনি নিজেও আহত হন।
শেখ হাসিনার এ সংগ্রামে জাতির পিতার মতো হাতিয়ার ছিল সততার আদর্শ ও শক্তি, লক্ষ্য অর্জনে তাঁর সম্পূর্ণ নিবেদিত প্রাণ, জনগণের কল্যাণে শতভাগ অঙ্গীকার, তাঁর প্রতি জনগণের অগাধ বিশ্বাস ও মমত্ববোধ, সর্বোপরি দেশজুড়ে আওয়ামী লীগের মতো নিবেদিতপ্রাণ কর্মীনির্ভর শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠন। ১৯৮১ সাল থেকে প্রায় ৪ দশক ধরে তিনি সভানেত্রী হিসেবে আওয়ামী লীগের সফল নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। কাউন্সিলরগণ প্রতিবারই সর্বসম্মতিক্রমে ঐ পদে তাঁকে নির্বাচিত করে আসছেন।
বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে শেখ হাসিনার প্রতি নেতা-কর্মী-কাউন্সিলরদের বিশেষ স্নেহ, ভালোবাসা তো রয়েছেই। এর ওপর আরো যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, তাঁর নেতৃত্বের যোগ্যতা। শুধু দলের মধ্যেই নয়, ঐ গণ্ডি পেরিয়ে শেখ হাসিনা আজ বিশ্বনন্দিত নেত্রী। তবে তাঁর ভরসার প্রধান ও সর্বশেষ অবলম্বন আওয়ামী লীগ ও এর সাধারণ নেতা-কর্মীরাই। সংগঠনগতভাবে দেখলেও, আওয়ামী লীগের শক্তিভিতের মূল উৎস এর মাঠ পর্যায়ের সুবিশাল কর্মীবাহিনী। ৭৫-এর ১৫ই আগস্ট আপনজন বলতে প্রায় সবাইকে হারিয়ে আওয়ামী লীগই যেন আজ শেখ হাসিনার নিজ পরিবার, যে পরিবারের প্রধান অভিভাবক এখনও বঙ্গবন্ধু স্বয়ং। দলের সাধারণ নেতা-কর্মীরাও শেখ হাসিনাকে অনুরূপভাবে বরণ করে নিয়েছেন। ১/১১-পরবর্তী ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে শেখ হাসিনা সংগঠনের মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের ভূমিকার প্রশংসা করে বলেন,
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অনেক ঘটনা ঘটেছে। তৃণমূল নেতাদের দৃঢ়তার কারণে দলকে এ পর্যন্ত নিয়ে আসা গেছে, ‘আপনারা আমাকে রক্ষা করেছেন’, আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে ‘কর্মীরাই হাল ধরে’।
উল্লেখ্য, আগরতলা রাষ্ট্রদ্রোহিতা মামলা থেকে ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে মুক্তিলাভের পর ১৯৭০ সালের ৪-৫ই জুন মতিঝিল ইডেন হোটেলে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু তাঁর কারাবন্দি থাকাকালীন কতিপয় সিনিয়র নেতার আওয়ামী লীগকে ভাঙ্গার চেষ্টা এবং তখন দলের মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের ভ‚মিকার প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেছিলেন,
আমি যখন কারাগারে সেই সুযোগে নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান যুক্তফ্রণ্ট [পিডিএম] গঠনের নামে আওয়ামী লীগের মধ্যে ভাঙ্গন সৃষ্টি এবং আমাকে ডিসমিস করিয়া নতুন পাল্টা আওয়ামী লীগ গঠন করেন। কিন্তু তিনি জানিতেন না নেতা নেওয়া যায়, কর্মী নেওয়া যায় না, তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক রক্তের।
ক্ষমতার বাইরে তো বটেই, এমনকি ক্ষমতায় থাকাকালেও আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত ও প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তির ষড়যন্ত্র, সন্ত্রাসী তৎপরতা ইত্যাদি মোকাবিলা করে সব সময় এগিয়ে যেতে হয়েছে। যেমন সরকার গঠনের ৫১ দিনের মধ্যে ২০০৯ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি পিলখানার বিডিআর বিদ্রোহ (যাতে বেশ কিছু সংখ্যক সেনা অফিসার নির্মম হত্যার শিকার হন), ২০১৩ সালের ৫-৬ই মে ঢাকার মতিঝিল শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের রাস্তা দখল করে অবস্থান গ্রহণ, ২০১২ ও ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল, ৫ই জানুয়ারি ২০১৪ অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিহত করা এবং ২০১৫ সালে নির্বাচনের এক বছর পূর্তিতে বিএনপি-জামায়াত জোটের দেশজুড়ে রাস্তা কেটে, রেল লাইনের স্লিপার উপড়ে ফেলে, গাছ কেটে রাস্তায় অবরোধ সৃষ্টি, চলন্ত গাড়িতে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে নির্বিচারে যাত্রীদের হত্যা, আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হত্যা ইত্যাদি চরম সন্ত্রাসী ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি শেখ হাসিনার সরকারকে মোকাবিলা করতে হয়েছে। পাশাপাশি এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছে উন্নয়নের ‘ভিশন ২০২১’। সংক্ষেপে, এটিই হলো পঁচাত্তর-পরবর্তী আওয়ামী লীগের পথ চলার ইতিহাস।
এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মোট ৪ বার সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনার সুযোগ লাভ করে। প্রথমবার বঙ্গবন্ধু-হত্যার ২১ বছর পর ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত। এরপর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমল (২০০১-২০০৬) এবং ২০০৭-২০০৮ সময়ে সেনাসমর্থিত তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল শেষে ২০০৯ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে ৩ টার্মের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনা করে আসছে। উল্লিখিত এ ৪ টার্মে জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের অর্জনসমূহ নিম্নরূপ-
সংসদীয় ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ, কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ (২৬শে সেপ্টেম্বর ১৯৭৫) বাতিল (১২ই নভেম্বর ১৯৯৬) করে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচার অনুষ্ঠান ও রায় কার্যকর করা, ৭১-এর স্বাধীনতা ও মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রায় কার্যকর করা, ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিন্যু-এ তাঁর সন্ত্রাসবিরোধী শান্তি সমাবেশে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ছত্রছায়ায় সন্ত্রাসী-জঙ্গিগোষ্ঠীর গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত ও কয়েকশ লোক আহত হওয়ার ঘটনায় জড়িতদের আইনের আশ্রয় এনে বিচারের ব্যবস্থা, গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি (১২ই ডিসেম্বর ১৯৯৬), পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি (২রা ডিসেম্বর ১৯৯৭), খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, অক্ষম-দুস্থদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বিধান, গ্রামীণ জনগণের স্বাস্থ্যসেবার জন্য ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন, বয়স্ক, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তাদের জন্য মাসিক ভাতা, ছিন্নমূল ও গৃহহীনদের জন্য ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প’, ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ কর্মসূচি, বস্তিবাসীদের জন্য ঘরে ফেরার কর্মসূচি, অসহায় বৃদ্ধদের বসবাসের জন্য ‘শান্তি নিবাস’ তৈরি, হতদরিদ্রদের জন্য ভিজিএফ কার্ডের মাধ্যমে বিনামূল্যে খাদ্য সাহায্য, মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ, নারীর ক্ষমতায়ন, ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ইউনেস্কো কর্তৃক ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন (১৭ই নভেম্বর ১৯৯৯), ইউনেস্কো কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের বিশ্ব-ঐতিহ্য সম্পদ হিসেবে ‘ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’-এ অন্তর্ভুক্তি (৩০শে অক্টোবর ২০১৭), অগণতান্ত্রিক ও সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা’ রহিতকরণ (পঞ্চদশ সংশোধনী, ৩রা জুলাই ২০১১), নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু (৬.১৫ কিমি দীর্ঘ) নির্মাণ, মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি (১৪ই মার্চ ২০১২), ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি (৭ই জুলাই ২০১৪), ভারতের সঙ্গে ছিটমহল বিনিময় (৩১শে জুলাই ২০১৬), কর্ণফুলী নদীতে টানেল নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ, দেশের দক্ষিণ অঞ্চলে পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রকল্প, ঢাকা শহরে মেট্রো রেল প্রকল্প, রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, মহাশূন্যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ (১২ই মে ২০১৮), জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান কঠোর হস্তে দমন, সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বেতনভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সর্বোচ্চ শতকরা ১২৩ ভাগ বেতন বৃদ্ধিসহ নতুন পে-স্কেল ২০১৫ ঘোষণা, প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমার থেকে নারী-শিশু-বৃদ্ধসহ ১১ লক্ষ জীবনবিপন্ন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয়দান, বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা বৃদ্ধি (২০ হাজার মেগাওয়াট), দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ১০০টি অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ, গড় আয়ু বৃদ্ধি (৭৩ বছর), প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি (৭.৮৬%), মানুষের মাথাপিছু আয়বৃদ্ধি (১৯০২ মার্কিন ডলার), দারিদ্র্যের হার হ্রাস (৪৪ থেকে ২১ শতাংশ), অতিদারিদ্র্য হার হ্রাস (২২ থেকে ১১ শতাংশ), জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন, কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে ভর্তির হার শতকরা ১ ভাগ থেকে ২০ ভাগে উন্নীত, দেশের ১০০টি উপজেলায় প্রত্যেকটিতে ১টি করে টেকনিক্যাল স্কুল স্থাপন প্রকল্প, নিম্নমাধ্যমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত আইসিটি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ওয়েবসাইট চালু, দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে ১৪টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে দুটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৫টি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, উচ্চশিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিতকরণে অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল এ্যাক্ট ২০১৭ পাস, মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকীকরণ, প্রধানমন্ত্রী শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট গঠন, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য ব্রেইল পদ্ধতির পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য নিজস্ব ভাষায় পাঠ্য বই রচনা, শিক্ষা পাঠ্যক্রমে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা, সাক্ষরতার হার ৭৩ শতাংশে উন্নীত, শতভাগ শিশুর বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিতকরণ, ঝড়ে পড়া রোধ, বছরের প্রথম দিন প্রায় ৩৮ কোটি পাঠ্যপুস্তক মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত বিনামূল্যে বিতরণ, নারী শিক্ষা প্রসারে বিশেষ গুরুত্বারোপ, ২১০০ সালকে লক্ষ্য মাত্রায় রেখে ডেল্টা পরিকল্পনা গ্রহণ, বাংলাদেশের জন্য জাতিসংঘের উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি অর্জন (১৫ই মার্চ ২০১৭) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এক কথায়, জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার সরকারের অর্জন বিশাল।
তবে ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ১২ই জুনের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বিজয় ও সরকার গঠন ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে যুগান্তকারী ঘটনা। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও ভাবাদর্শের পুনঃপ্রত্যাবর্তন ঘটার (Restoration of the Ideals of War of Liberation) ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ কথাও সত্যি, বিগত ৪৯ বছরে বিশেষকরে ৭৫-এর ১৫ই আগস্ট-পরবর্তী সেনাশাসন, বিএনপি এবং পরবর্তীকালে জামায়াত-বিএনপি’র শাসনামলে বাংলাদেশের সমাজ-রাজনীতিতে ধর্মের ব্যাপক ব্যবহার/অপব্যবহার ঘটেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা বৈশ্বিক উপাদান। পরিবর্তনের এ বিষয়টি শেখ হাসিনার মতো এতো স্পষ্টভাবে আর কেউ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন বলে মনে হয় না। তাই ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ সংবিধানে রয়ে গেলেও শেখ হাসিনার দ্বিতীয় সরকারের আমলে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে (জুন ২০১১) ৭২-এর সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূল চার রাষ্ট্রীয় নীতি পুনঃস্থাপিত হয়। সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতা সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা ও ধারণার আলোকে উল্লিখিত সংবিধান-সংশোধনীতে সকল ধর্মবিশ্বাসের প্রতি সমান গুরুত্বারোপ করা হয়। জনগণের ধর্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে তাদের মধ্যে কেউ যাতে সাম্প্রদায়িক বিভেদ-বিদ্বেষ ছড়াতে না পারে, সে ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও সংবিধানে সুষ্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়।
বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল এবং জাতিসংঘ কর্তৃক মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃত। ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে শেখ হাসিনার সরকার কাজ করে যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ এদেশে ব্যতিক্রমধর্মী একটি রাজনৈতিক দল। জাতির স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্বদানের পরও দীর্ঘ সময় ধরে দোর্দণ্ড প্রতাপে রাজনীতির অগ্রভাগে থেকে কোনো দলের এরূপ সাত দশক ধরে নেতৃত্বদানের উদাহরণ খুব বেশি পাওয়া যাবে না। তাহলে আওয়ামী লীগের এই অন্তর্নিহিত শক্তির উৎস কী? এক. তারুণ্য। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার দেড় বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (৪ঠা জানুয়ারি ১৯৪৮), বর্তমান ছাত্রলীগ যার উত্তরাধিকার। আর তারুণ্য মানেই শক্তি, গতি ও সৃষ্টি। বঙ্গবন্ধুর একটি মন্তব্য ছিল, ‘ছাত্রলীগ এ দেশের গণসংগ্রামের জনক।’ তারুণ্যকে দলের সঙ্গে যুক্ত রাখার ধারা বর্তমানেও আওয়ামী লীগে অক্ষুণ্ণ রয়েছে। দুই. ধারণ ক্ষমতা ((absorbing capacity)। আওয়ামী লীগের ধারন ক্ষমতা অফুরন্ত, যা দলের জন্য শক্তি সঞ্চয়ে খুবই সহায়ক। তিন. পরিবর্তনশীলতা বা পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে সহজে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হওয়া (adaptability)। চার. বাস্তববাদিতা (realism/real politic approach) অর্থাৎ যথাসময় যথাকর্মটি করা বা সঠিক কর্মসূচি উপস্থাপন, যেমন ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা, ২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে শেখ হাসিনার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকার। পাঁচ. অগ্রবর্তী চিন্তা বা কর্মসূচি, যেমন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৬৪ সালের কাউন্সিল অধিবেশনে আওয়ামী লীগ-এর যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের প্রস্তাব, ১৯৭০ সালের কাউন্সিলে মহকুমাগুলোকে জেলায় উন্নত করার প্রস্তাব; ২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে শেখ হাসিনার পদ্মাসেতু ও চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে ট্যানেল নির্মাণের পরিকল্পনা ঘোষণা, শেখ হাসিনার ‘ভিশন ২০২১’ বা ডিজিটাল বাংলাদেশ ইত্যাদি।
আওয়ামী লীগ শুধু ক্ষমতা প্রত্যাশী একটি গতানুগতিক রাজনৈতিক দল নয়। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতির একটি বিশেষ ধারার প্রতিনিধিত্বকারীও। সেই ধারাই হচ্ছে বাংলাদেশের মূলধারা। এর সারকথা হচ্ছে, সমন্বয়, সমতা ও সম্প্রীতি। দেশের বৃহত্তম, দায়িত্বশীল ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আওয়ামী লীগ শুধু দেশ পরিচালনায়ই নেতৃত্ব দেয় না, একই সঙ্গে দেশবাসীর সম্মুখে তুলে ধরে পথ চলার অগ্রবর্তী চিন্তাও। আওয়ামী লীগ আজ যা ভাবে, এ দেশে অনেক দল তা কাল কিংবা কখনো ভাবতে পারে না।
পরিশেষে, বাংলাদেশে স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব যেমন অপরিহার্য ছিল, তদ্রুপ বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষামুক্ত, উন্নত-সমৃদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠন তথা জাতির পিতার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠায় তাঁরই রক্ত ও আদর্শের উত্তরাধিকারী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বও আজ অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ব্যতিত বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি ও ৭১-এর যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধীদের বিচার অনুষ্ঠান ও বিচারের রায় কার্যকর করা, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ, বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতকরণ ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বর্তমানে যে উচ্চতায় পৌঁচেছে এর কোনোটাই যে অর্জন বা বাস্তবায়ন সম্ভব হতো না, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। পিতার মতো তাঁরও একটি মাত্র চাওয়া-পাওয়া, আর তা হচ্ছে দেশ ও মানুষের কল্যাণ, বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘দুঃখি মানুষের মুখে হাসি ফোটানো’। সাম্প্রতিক প্রাণঘাতি করোনার হাত থেকে মানুষের জীবন বাঁচাতে তিনি যেভাবে এগিয়ে এসেছেন, দিন-রাত পরিশ্রম করে চলেছেন, তা সমগ্র জাতি গভীর কৃতজ্ঞতায় প্রত্যক্ষ করছে। পিতার মতো তিনিও রাজনীতিকে গ্রহণ করেছেন ত্যাগের আদর্শ হিসেবে। তাঁর সৎ, যোগ্য ও দৃঢ় নেতৃত্বে বাংলাদেশ যে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণে অনেক দূর এগিয়ে যাবে, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।