দেশীয় প্রযুক্তিতে স্মার্ট স্যানিটারি ন্যাপকিন ভেন্ডিং মেশিন উদ্ভাবন করেছেন তারিফ

বার দেশীয় প্রযুক্তিতে স্মার্ট স্যানিটারি ন্যাপকিন ভেন্ডিং মেশিন উদ্ভাবন করেছেন কলেজছাত্র তাহের মাহমুদ তারিফ। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা পিরিয়ড চলাকালীন অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে এ ভেন্ডিং মেশিনের মাধ্যমে স্যানিটারি ন্যাপকিন সংগ্রহ করতে পারবেন। এরইমধ্যে তারিফের উদ্ভাবিত দুটি স্যানিটারি ভেন্ডিং মেশিন পাবনার ঈশ্বরদী পৌর শহরের সরকারি সাঁড়া মাড়োয়ারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে স্থাপন করা হয়েছে। এর আগে করোনাকালীন দেশে যখন অক্সিজেনের সংকট তখন স্বল্প খরচে কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন উৎপাদন যন্ত্র ‘অক্সিজেন কনসেনট্রেটর’ আবিষ্কার করে দেশজুড়ে আলোচিত হন স্কুলছাত্র তাহের মাহমুদ তারিফ। খুদে উদ্ভাবক হিসেবে তারিফ ২০২২ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে শেখ রাসেল স্বর্ণপদক লাভ করেন। ২০২০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত চারটি জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলায় জেলা পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ খুদে বিজ্ঞানী হিসেবে পুরস্কার লাভ করেন তিনি।

ঈশ্বরদী সরকারি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র তারিফ ২০২১ সালে সরকারি সাঁড়া মাড়োয়ারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে দশম শ্রেণিতে অধ্যায়নরত অবস্থায় অক্সিজেন কনসেনট্রেটর যন্ত্র আবিষ্কার করেন। এরইমধ্যে তারিফের উদ্ভাবিত অক্সিজেন কনসেনট্রেটর যন্ত্র আইসিটি মন্ত্রণালয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর মন্ত্রণালয়ের ‘এ টু জেড’ গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে অক্সিজেন কনসেনট্রেটর যন্ত্র তৈরির জন্য তাকে ১০ লাখ টাকা অর্থায়ন করা হয়। এ টাকা দিয়ে তারিফ অক্সিজেন কনসেনট্রেটর যন্ত্রটি আরও আধুনিকভাবে উদ্ভাবনের গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এতদিন একটি কনসেনট্রেটর যন্ত্রের মাধ্যমে একজন রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া যেত এখন দুজন অথবা তার অধিক রোগীকে এ সেবা দেওয়া যাবে।

এবার সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে নিজস্ব উদ্ভাবনের মাধ্যমে স্যানিটারি ন্যাপকিন ভেন্ডিং মেশিন তৈরি করেছেন তারিফ। এটি তৈরিতে তার পাঁচ মাস সময় লেগেছে। ব্যয় হয়েছে ২৫ হাজার টাকা।

স্যানিটারি ন্যাপকিনের ভেন্ডিং মেশিন উদ্ভাবনের ব্যাপারে তাহের মাহমুদ তারিফ বলেন, আমাদের দেশে স্কুল-কলেজগুলোতে বিশেষত স্কুলগুলোতে নারী শিক্ষার্থীদের যখন শারীরিক পরিবর্তন হয় তখন শুরুর দিকে তারা অনেক সময় দোকান থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে অস্বস্তিবোধ করেন। সেক্ষেত্রে ভেন্ডিং মেশিন থেকে খুব সহজেই কয়েন ব্যবহার করে স্বল্পমূল্যে প্যাড সংগ্রহ করতে পারবেন। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারীদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী স্যানিটারি ন্যাপকিন সেবা প্রদানের লক্ষ্যেই আমার এই উদ্যোগ।

তিনি বলেন, ভেন্ডিং মেশিনে স্যানিটারি ন্যাপকিন বা প্যাড রাখা থাকবে। প্রয়োজনের সময় মেশিনটিতে ৫ টাকার কয়েন দিয়ে সহজেই ন্যাপকিন বা প্যাড পাওয়া যাবে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে মোবাইলে মেসেজের মাধ্যমে স্টক শেষ হওয়ার আগেই রিফিল করার জন্য বার্তা দেওয়া হবে।

প্রচলিত ভেন্ডিং মেশিনের তুলনায় এর খরচ কম হওয়ায় প্রযুক্তিটি সর্বোত্তম ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। এই মেশিনটি ব্যবহারের ফলে পিরিয়ডকালীন নারী শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলেও জানান তিনি।

তিনি আরও বলেন, ভেন্ডিং মেশিন এদেশে বহু প্রতিষ্ঠানে রয়েছে। সেগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করা। আমার উদ্ভাবিত ভেন্ডিং মেশিনের চেয়ে আমদানি করা মেশিনের দাম প্রায় দ্বিগুণ।

জানা যায়, তাহের মাহমুদ তারিফ অক্সিজেন কনসেনট্রেটর যন্ত্র ও স্যানিটারি ন্যাপকিনের ভেন্ডিং মেশিন আবিষ্কারের পাশাপাশি সুপার ফাস্ট ব্যাটারি চার্জিং টেকনোলজি উদ্ভাবন করেছেন। যার সাহায্যে অটোরিকশা তিনগুণ দ্রুত চার্জ হবে। ফায়ার রেসকিউ রোবট উদ্ভাবন করেছেন তিনি। যার মাধ্যমে মানুষের সহযোগিতা ছাড়াই আগুন নেভানো সম্ভব। এছাড়া তার উদ্ভাবিত বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার কন্ট্রোলিং সিস্টেম, সেভ এসি কনর্ভাটার, স্মার্ট রোড ম্যানেজমেন্ট লাইটিং সিস্টেম, স্মার্ট রেলক্রসিং সিস্টেম, কৃত্রিম উপায়ে বৃষ্টি নামানোর আর্টিফিসিয়াল রেইন রকেটসহ আরও কিছু আবিষ্কা আইসিটি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায়।

তাহের মাহমুদ তারিফের মা তসলিমা খাতুন বলেন, তিন সন্তানের মধ্যে তারিফ সবার ছোট। ছোটবেলা থেকেই তার মধ্যে উদ্ভাবনী ভাবনা ছিল। তারিফের বাবা করোনাকালীন মারা যান। দেশজুড়ে চরম অক্সিজেন সংকট চলছিল। তখন তারিফ অক্সিজেন কনসেনট্রেটর আবিষ্কার করেন। এছাড়া তার উদ্ভাবিত স্যানিটারি ভেন্ডিং মেশিন, সুপার ফাস্ট ব্যাটারি চার্জিং মেশিন ও কৃত্রিম উপায়ে বৃষ্টি নামানোর জন্য আর্টিফিসিয়াল রেইন রকেট আবিষ্কারসহ আর অনেক কিছু উদ্ভাবন রয়েছে। তার সব আবিষ্কার আইসিটি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য সেখানে জমা দিয়েছে। তার আবিষ্কারের প্রতিভা রয়েছে। আর্থিক জোগান দিতে না পারায় অনেক কিছু তার পক্ষে আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি।

অক্সিজেন কনসেনট্রেটর যন্ত্র আবিষ্কারের পর সরকার এ মেশিন নিয়ে গবেষণা ও কয়েকটি তৈরির জন্য আর্থিক সহযোগিতা করেছিল। সরকার তারিফকে পৃষ্ঠপোষকতা দিলে তার দ্বারা আরও অনেক কিছু উদ্ভাবন করা সম্ভব হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সরকারি সাঁড়া মাড়োয়ারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শহিদুল হক শাহীন বলেন, তাহের মাহমুদ তারিফ ২০২১ সালে এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এসএসসি পাস করেছেন। তার উদ্ভাবিত দুটি স্মার্ট স্যানিটারি ন্যাপকিন ভেন্ডিং মেশিন আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের জন্য স্থাপন করেছি। এই ভেন্ডিং মেশিন খুবই যুগোপযোগী। তারিফ এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্কুল শাখায় পড়াশোনার সময় অক্সিজেন কনসেনট্রেটর উদ্ভাবন করেন। এটি উদ্ভাবনের প্রাথমিক ব্যয় এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বহন করে। পরে ঈশ্বরদীর ইউএনও, পাবনা জেলা প্রশাসক মহোদয় ও সরকারের আইসিটি মন্ত্রণালয় তাকে সার্বিকভাবে আর্থিক সহযোগিতা করে।

ঈশ্বরদী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ এস এম রবিউল ইসলাম বলেন, খুদে বিজ্ঞানী হিসেবে সে উদ্ভাবনীতে যে অবদান রেখেছে তা প্রশংসনীয়। সে একের পর এক বিজ্ঞানে উদ্ভাবনীয় অবদান রেখে জাতীয় পর্যায়ে যে একাধিক পুরস্কার লাভ করেছে, তাতে গোটা ঈশ্বরদীর মুখ উজ্জ্বল করেছে সে। তারিফ মাহমুদের যে কোনো উদ্ভাবনী সহযোগিতায় ঈশ্বরদী সরকারি কলেজ তাকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করবে।