মুঠোফোন! যা আমাদের নৃত্য দিনের সঙ্গী, বিনোদনে প্রধান মাধ্যম। শুধুই কি ফোনালাপ কিংবা ক্ষুদে বার্তা পাঠানো? মোবাইল এখন ব্যাংকিং টুলস, বিল পরিশোধ, জমির খাজনা, আয়কর রিটার্ন, ভ্যাট প্রদান থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের বাহন। সেই মুঠোফোনেই খেলা যাচ্ছে জুয়া (বেটিং)। সর্বনাশের শেষ পর্বটিও এখন মানুষের আঙুলের নাগালে। বেটিং অ্যাপে জুয়ার ফাঁদ যে শুধু শহরকেন্দ্রিক তা নয়। শহর ছাপিয়ে তা এখন দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে। অতি লোভে পড়ে জুয়ার ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ। এক ধরনের কৌতূহল থেকে তরুণ প্রজš§ আকৃষ্ট হচ্ছে বিভিন্ন জুয়ার সাইটে। পাঁচশ বা হাজার টাকা বিনিয়োগ দিয়ে শুরু করে লোভে পড়ে একপর্যায়ে হারাচ্ছে লাখ লাখ টাকা। জুয়ার এসব সাইটের অধিকাংশই পরিচালনা করা হচ্ছে বিদেশ থেকে। ফেসবুক-ইউটিউবে প্রচার করা হচ্ছে এসব সাইটের তথ্য। অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে উড়ছে কোটি কোটি টাকা। এই টাকার একটি বড় অংশ পাঁচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে। জুয়াড়ি চক্রের সদস্যরা মাঝে মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়লেও বেশির ভাগই থাকছে অধরা। জুয়ায় আর্থিক লেনদেনের সহজ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বাংলাদেশি মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস)।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো জুয়ার একাধিক সাইটে বাংলাদেশিদের লেনদেনের জন্য মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায় যুক্ত। এ ছাড়া রয়েছে ব্যাংকের মাধ্যমেও পেমেন্ট করার সুযোগ। ব্যাংক এশিয়া, ব্র্যাক ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড ও ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে লেনদেন করা যায় এসব সাইটে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে গত এক বছরে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের হিসাব বা অ্যাকাউন্টের সংখ্যা বেড়েছে দুই কোটি ৯১ লাখ ৯৫ হাজার ৮৬৬টি। চলতি বছরের আগস্ট শেষে মোট মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ২১ কোটি ২৪ লাখ ২০ হাজার ৪৭৬। এক বছর আগে ২০২২ সালের আগস্ট শেষে যা ছিল ১৮ কোটি ৩২ লাখ ২৪ হাজার ৬১০টি। এই হারে অ্যাকাউন্ট বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে অনলাইন জুয়ার কথা বলছেন অনেকে।
চলতি বছর জুলাইতে বিটিআরসিকে অবিলম্বে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও টেলিভিশন; বিশেষ করে স্পোর্টস চ্যানেলসহ ডিজিটাল ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে অনলাইনে বাজি ও জুয়ার বিজ্ঞাপন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। তবে হাইকোর্টের নির্দেশ থাকলেও প্রচার থেমে নেই। অনুসন্ধানে দেখা যায়, এসব অনলাইন ক্যাসিনো দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত হলেও সমন্বয়ের জন্য দেশীয় সিন্ডিকেট রয়েছে, যারা এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। তাদের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ফেসবুক গ্রুপ বা পেজ খুলে প্রচার চালানো হচ্ছে। জুয়া খেলা বেশি করে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের টার্গেট করে জুয়ার সাইটের বিজ্ঞাপন দেয়া হচ্ছে বাংলায়। অনলাইন ক্যাসিনোর অ্যাপ ইনস্টলের জন্যও দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন অফার। এমনকি বিজ্ঞাপনে বাংলাদেশের বিভিন্ন সেলিব্রিটির ছবিও দেখা যাচ্ছে।
অনলাইন জুয়ার সাইট বেটউইনার এর অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বেটউইনার নিউজের দূত হিসেবে চুক্তি করে একবার বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সবচেয়ে বড় তারকা সাকিব আল হাসান। ব্যাপক সমালোচনা ও বিসিবির শাস্তির হুমকিতে সেই চুক্তি শেষ পর্যন্ত বাতিল করতে বাধ্য হন সাকিব। কিন্তু সেই ভুল থেকে শিক্ষা নেননি বাংলাদেশ ক্রিকেটের অধিনায়ক। ফের একটি অনলাইন জুয়ার সাইটের সঙ্গে জড়িয়েছে সাকিবের নাম। বাবু৮৮ নামে একটি অনলাইন ক্যাসিনো ও ক্রিকেট এক্সচেঞ্জ সাইটের বিজ্ঞাপনে দেখা যাচ্ছে সাকিবকে। সেই বিজ্ঞাপনে সাকিব দাবি করছেন যে, ‘বাবু৮৮’ সাইটটি বাংলাদেশের এক নম্বর স্পোর্টস প্লাটফর্ম। যেখানে ক্রিকেটসহ বাকি সব খেলার আপডেট পাওয়া যাবে। তবে সাইটটিতে ঢুকলে দেখা যায়, এখানে ক্রিকেট নিয়ে বাজি তো ধরাই যায়, চাইলে খেলা যায় ক্যাসিনো, স্লট গেমের মতো জুয়াও। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে জুয়া নিষিদ্ধ হলেও এসব জুয়ার সাইটের বিজ্ঞাপন যেমন বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে দেখা গেছে এবং ইউটিউব চ্যানেলগুলোতেও প্রচার হতেও দেখা যাচ্ছে। এমনই একটি অনলাইন জুয়ার সাইটের বিজ্ঞাপন প্রচার করায় বাংলাদেশের জনপ্রিয় এক ইউটিউবার এবং তার দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি পুলিশ। গতবছর চব্বিশে ফেব্রুয়ারি তাদের নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
অনলাইন জুয়া প্রতিরোধে নতুন আইন করছে সরকার। এজন্য নতুন ‘জুয়া আইন, ২০২৩’ এর খসড়া করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। মূলত ১৮৬৭ সালের ‘দ্য পাবলিক গ্র্যাম্বলিং অ্যাক্ট’ যুগোপযোগী করে নতুন আইনটি করা হচ্ছে। নতুন আইনে অনলাইন জুয়া অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। কারণ অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে; এ জুয়ার খপ্পরে নিঃস্ব হচ্ছেন অনেকে। খসড়া আইনে বলা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগ বা অন্য কোনো অনলাইন বা ইলেক্ট্রনিক বা ডিজিটাল মাধ্যমে খেলাধুলা বা এ-সংক্রান্ত অন্য কোনো বিষয়ে বাজি ধরলে বা বাজি ধরার জন্য নগদ বা ক্যাশবিহীন ব্যাংকিং লেনদেন (যেমন- ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড ইত্যাদি) বা মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেন (যেমন- বিকাশ, রকেট, নগদ, উপায়, পেপল ইত্যাদি) বা বিট কয়েনসহ অন্য যে কোনো ক্রিপ্টোকারেন্সি ইত্যাদি বা অন্য কোনো ধরনের ইলেক্ট্রনিক বা ডিজিটাল মাধ্যমে লেনদেন করলে তবে তা অনলাইন বেটিং বা জুয়া হবে। এ ছাড়া নিজ বা অন্যের ব্যবহারের উদ্দেশ্যে অনলাইন বেটিং সাইট বা অ্যাকাউন্ট রেজিস্টার করেন বা হোস্টিং দেন বা জুয়ার এজেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বা মাসিক ভাড়া বা অন্য কোনো প্রতিশ্রুতিতে দেশে বা বিদেশে অবস্থানরত কোনো ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেন বা এ উদ্দেশ্যে পরামর্শের জন্য ওয়েবসাইট বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পরিচালনা করেন তবে তাও অনলাইন জুয়ার আওতাভুক্ত হবে বলে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে। খসড়া আইনে জুয়ার শাস্তি সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড। আগের আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল ৫০০ টাকা জরিমানা ও তিন মাসের জেল।
জুয়ার সাইট বন্ধ করেও মিলছে না সমাধান। ২০১৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) এক বিজ্ঞপ্তিতে অনলাইনে জুয়া খেলার ১৭৬টি সাইট বন্ধ করার কথা বলা হয়। ২০২২ সালের ১০ অক্টোবর ৩৩১টি অনলাইন জুয়ার সাইট বন্ধ করে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা সেল’।। তবুও বর্তমানে বিভিন্ন পন্থায় বিভিন্ন সাইটে জুয়া খেলা হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বিটিআরসির চেয়ারম্যান বলেন, কেউ যদি হুট করে একটি জুয়ার সাইট খোলে, সার্বক্ষণিকভাবে হয়তো আমাদের নজরে আসে না। আমাদের নজরে যেগুলো আসছে সেগুলো বন্ধ করে দিচ্ছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে এলে তারাও বিটিআরসিকে বলে এবং আমরা সেই সাইটগুলো বন্ধ করে দেই। জুয়ার সাইট বন্ধ করা আমাদের চলমান প্রক্রিয়া। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্পোর্টস ৩৩৩ ডটকম, নেটবেট ডটকম, প্লেবেট৩৬৫ ডটকম, পেডি পাওয়ার ডটকম, বেট ৩৬৫ ডটকম, বেট উইন ৯৬ ডটকম, বেট বাটার ফ্লাই ডটকম, বেট ভিক্টর ডটকম, বেটস্কোর২৪ ডটকম, বেটফেয়ার ডটকম, বেটফ্রিড ডটকম, বেটবি২ডটকম, রেবটওয়ে ডটকম, ৬ক্রিকেট ডটকম, ৮৮ স্পোর্টস ডটকম, ৯ক্রিকেট, ইউনিবেট ডটকম, ইন্ডিতা৯৬ ডটকম, উইনস৬৫ ডটকম, উইনার ডটকম, বাজীগর ডটকম, এলবিএস২৪ ডটকম, ওপেন বেট ডট লাইভ, লগ১০ ডট লাইভ, লাক বেট বিডি ডটকম, জয়টি২০ ডটকম, টাইটানবেট ডটকম, টাকা৬৫ ডটকম, বিডিটি১০ডটকম, ভিক্টর২৬ ডটকম ও ডাফাবেট ডটকমসহ অর্ধশতাধিক জুয়ার অনলাইন সাইট রয়েছে। এবং এই সাইট গুলোতে বাংলাদেশের গেটওয়ে ব্যবহার করেই সহজে প্রবেশ করা যাচ্ছে। এসব সাইটের অ্যাপগুলো গুগল প্লে স্টোরে পাওয়া যায় না। গুগল থেকে সার্চ করে বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে অ্যাপস ডাউনলোডের লিংক পাওয়া যাচ্ছে। তথ্য বলছে, এসব বেটিং সাইট বিটিআরসির নজরে এলে বন্ধ করা হয়। তবে অত্যন্ত চালাক-চতুর হওয়ায় এসব সাইট পরিচালনাকারীরা বিদেশে বসে বন্ধ হওয়া সাইটগুলো রাতারাতি ভিন্ন ডোমেইনে হুবহু চালু করে পরিচালনা করছে। আবার কেউ কেউ ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) ব্যবহার করেই এসব সাইটে খেলছে জুয়া। এ ছাড়া কিছুকিছু সাইটের অ্যাপসও রয়েছে। যা সহজে বন্ধ করা যায় না। মূলত এসব সাইটে সরাসরি কেউ অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে না। এজন্য জুয়াড়িদের সহযোগিতায় রয়েছে ফেসবুক গ্রুপ। সঙ্গে ইউটিউবেও দেখানো হয় জুয়া খেলার টিউটিরিয়াল। এসব গ্রুপ ও টিউটেরিয়াল দেখে বাজি খেলায় উদ্বুদ্ধ হচ্ছে স্কুল-কলেজপড়ুয়া তরুণ-তরুণীরা। নিয়মিত অনলাইনে জুয়া খেলতেন জুনায়েদ আনসারী (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, ওয়ানএক্সবেটে জুয়া খেলতাম। প্রথমে নগদের মাধ্যমে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে সাইটে খেলা শুরু করি। এক রাতে পাঁচ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা লাভ হয়। পরদিন ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকায় খেলতে গেলে পুরো টাকা হেরে যাই। পরবর্তীসময়ে দুই লাখের মতো ইনভেস্ট করি। সেখানে খেলতে গিয়েও হেরে যাই। ‘বড় অংকের টাকা হেরে গিয়ে পরে পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে খেলা শুরু করি। সেখানে অনেক সময় দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ পর্যন্ত লাভ হয়, আবার অনেক সময় পুরো টাকাই হেরে যাই। এটি নেশার মতো। খেলতে শুরু করলে যতক্ষণ টাকা থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত খেলতে ইচ্ছে করে। টাকা শেষ হলে আবারও টাকা ইনভেস্ট করে খেলা শুরু করতে ইচ্ছে হয়।’ এ বিষয়ে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটু একটু করে বেটিং খেলা থেকেই একসময় নেশা আসক্ত হয়ে পড়ে তরুণরা। একটা সময় বড় ধরনের জুয়াড়িতে পরিণত হয়। এতে টাকার সংকটে একসময় পারিবারিক কলহের সৃষ্টি হয়। ফলে এটি একদিকে যেমন পারিবারিক ও সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়, অন্যদিকে তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা ক্রমেই বাড়তে থাকে। ফলে খুনের মতো ঘটনা ঘটাতেও তারা দ্বিধাবোধ করে না।
ডিএমপির গোয়েন্দা ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইনভেস্টিগেশনের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, অনলাইন জুয়া একটা নেশার মতো, এখানে একবার ঢুকলে নিঃস্ব হওয়া ছাড়া উপায় নেই। অংশগ্রহণকারীরা নিঃস্ব হওয়ায় পারিবারিক সহিংসতা বাড়ছে, আইনশৃঙ্খলার ওপর প্রভাব পড়ছে। আমাদের পুলিশের মনিটরিং বাড়ানো হয়েছে। সবাইকে সামাজিকভাবে আরও সচেতনতা বাড়াতে হবে।