জলাশয় ভরাট হচ্ছে, হ্রাস পাচ্ছে ভূখণ্ড

আলম শাইন: দেশের ঐতিহ্যবাহী জলাভূমি চলনবিল। রাজশাহী বিভাগের অন্তর্ভুক্ত বিলটি। ৩টি জেলা, ৮টি উপজেলা, ৬০টি ইউনিয়ন, ১ হাজার ৬০০ গ্রাম এবং ১৪টি নদী নিয়ে চলনবিলের বিস্তৃতি। বিশাল এই বিলের আয়তন নিয়ে বহু বিতর্ক রয়েছে আজও। ১৯১৯ সালে ‘ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া’র হিসাবমতে, চলনবিলের আয়তন ৫০০ বর্গমাইল বা প্রায় ১ হাজার ৪২৪ বর্গকিলোমিটার। অপরদিকে ১৯৬৮ সালের জরিপ মোতাবেক চলনবিলের আয়তন ৮০০ বর্গমাইল বা ২ হাজার ৭১ বর্গকিলোমিটার বলা হয়েছে। তবে বর্তমানে চলনবিল অনেকটাই হ্রাস পেয়ে আয়তন দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৫০ বর্গকিলোমিটারে।

গবেষকদের মতে, চলনবিল সংকুচিত হওয়ার পেছনে রয়েছে তিনটি বড় কারণ। প্রথমত, চলনবিলে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে ২২২.৫ মিলিয়ন ঘনফুট পলি প্রবেশ করছে। তার মধ্যে বিলের আশপাশ বা সীমানা এলাকা থেকে ৫৩ মিলিয়ন ঘনফুট পলি বিলে ঢুকছে। আর বাকি ১৬৯.৫ মিলিয়ন ঘনফুট পলি নদী দিয়ে বর্ষা মৌসুমে বিলে প্রবেশ করছে। এতে করে বিল দ্রুত ভরাট হয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, বিল এলাকায় অপরিকল্পিত বসতবাড়ি স্থাপনের কারণে ক্রমেই চলনবিল সংকুচিত হয়ে আসছে। তৃতীয়ত, চলনবিল এলাকার আশপাশে অপরিকল্পিতভাবে অনেক রাস্তাঘাট নির্মাণ হওয়ায় বিলের পরিধি হ্রাস পেয়েছে অনেকটাই। উল্লিখিত কারণ ছাড়াও দেখা গেছে, জাতীয় প্রয়োজনে সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল থেকে নাটোরের বনপাড়া পর্যন্ত প্রায় ৫৫ কিলোমিটারের একটি মহাসড়ক নির্মিত হয়েছে চলনবিলের

দুই-তৃতীয়াংশ জায়গা দখল করে। এই দীর্ঘ রাস্তাটি নির্মিত হওয়ার ফলে এলাকাবাসী উপকৃত হলেও চলনবিলের আয়তন হ্রাস পেয়েছে বেশ খানিকটা।

এ ধরনের রাস্তা নির্মাণের পেছনে প্রথমে ভূমিকা নিয়েছেন স্থানীয় লোকজনই। তারা বিলের পানি শুকিয়ে গেলে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাতায়াত করতে প্রথমে মেঠোপথ তৈরি করেন। তারপর স্থানীয় সরকারের কাছে সেসব স্থানে সড়ক নির্মাণের দাবি রাখেন। একটা সময় এলাকাবাসীর দাবি পূরণ হয়ে জন্ম নেয় নতুন সড়কের।

বাংলাদেশের নিম্ন জলময় ভূ-ভাগের মধ্যে একমাত্র চলনবিলই আয়তনের দিক দিয়ে সর্ববৃহৎ। এ অঞ্চলের মানুষের অভিমত, চলনবিল হচ্ছে অত্র এলাকার জন্য শস্যখনি, বাস্তবেও তাই। মূলত এখানকার মাটি বেশ উর্বরা। বিল শুকিয়ে এলে উর্বরা মাটিতে কৃষকরা ধানের চারা রোপণ করেই উল্লাস করেন। কারণ তারা জানেন স্বল্প ব্যয়ে তাদের গোলা ভরে যাবে সোনালি ধানে। শুধু তাই-ই নয়, বর্ষার শেষ নাগাদ পর্যন্ত চলে এখানে মাছ ধরার মহোৎসব। সেই হিসেবে বলা যায় চলনবিল মৎস্যখনিও। এখানে রয়েছে দেশীয় মাছের অফুরন্ত ভাণ্ডার। রুই, কাতলা, চিতল, বোয়াল থেকে শুরু করে চুনোপুঁটি পর্যন্ত এই বিলে কিলবিল করে। বিল এলাকার গৃহস্থদের এ সময় মাছ ক্রয়ের প্রয়োজন পড়ে না। জেলে সম্প্রদায়ের পাশাপাশি তারাও মাছ শিকার করে নিজেদের পারিবারিক চাহিদার জোগান দেন। চলনবিলে ইদানীং আরেকটি ব্যবসা জমজমাট হয়ে উঠেছে। সেটি হচ্ছে ঝিনুক-মুক্তার বাণিজ্য। এ বিলের জলে প্রাকৃতিক নিয়মে ঝিনুকের পেটে প্রচুর মুক্তার জন্ম হয়। এলাকার বেকার নারীরা ঝিনুক কুড়িয়ে পেট চিড়ে মুক্তা সংগ্রহ করে বড় বড় কারবারির হাতে তুলে দেন। বিনিময়ে তারা উপার্জন করেন নগদ অর্থকড়ি।

পর্যটকদের সুবিধার্থে বিল এলাকায় কেউ কেউ মোটেল নির্মাণের চিন্তাভাবনাও করছেন। সেটির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে এলাকার যুব সম্প্রদায়। তাদের ধারণা, হোটেল-মোটেলজাতীয় কিছু হলে বিপর্যয় নেমে আসবে চলনবিল এলাকায়। বিষয়টি মাথায় এনে এলাকার যুব সম্প্রদায় কিছুটা সোচ্চার হয়ে উঠেছে। চলনবিল রক্ষা কমিটি গঠনের তাগিদ বোধ করছেন তারা। অনেকে বিল রক্ষার্থে নানা ধরনের সামাজিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ারও অঙ্গীকার করছেন। আমাদের কামনা, চলনবিল রক্ষার্থে যেকোনো ধরনের বাধা মোকাবিলা করার শক্তি-সাহস অর্জন হোক যুব সম্প্রদায়ের। বাস্তবায়িত হোক তাদের দৃঢ়প্রত্যয়। পাশাপাশি আমরা প্রশাসনেরও শুভদৃষ্টি কামনা করছি, যেন ঐতিহ্যবাহী চলনবিলকে সংকুচিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে তারা। কারণ এটি আমাদের জাতীয় সম্পদ। এটি শুধু রাজশাহী বিভাগবাসীরই অহঙ্কার নয়, এটি সমগ্র দেশবাসীর অহঙ্কার।

এবার আসা যাক সুন্দরবনের কথায়। সুন্দরবন বাংলাদেশের জাতীয় বন। এই বন এবং বনের জীববৈচিত্র্য নিয়ে আমরা গর্বিত। কারণ বিশ্বের রোমাঞ্চকর অরণ্যগুলোর মধ্যে সুন্দরবন অন্যতম একটি বন। ফলে সুন্দরবন নিয়ে আমাদের যেমন ভাবনারও শেষ নেই, তেমনি শেষ নেই গবেষণারও। সুন্দরবনের নাম নিতে পারলেই যেন আমরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে পারি। এ পর্যন্তই আমাদের সুন্দরবনপ্রীতি।

সুন্দরবন দুভাবে তছরুপ হচ্ছে। দুষ্কৃতকারীদের মাধ্যমে যেমনি, তেমনি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কবলেও পড়ছে বারবার। বিভিন্নভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সুন্দরবন। যেমন ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, বৃক্ষ নিধন, অগ্নিকাণ্ড, চোরাকারবারির আধিপত্যসহ নানাভাবে বন তছরুপের শিকার হচ্ছে। হালে যোগ হয়েছে বনভূমি দখল এবং নদীভাঙন। দেখা যাচ্ছে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে পণ্যবাহী নৌযান চলাচলের কারণে বিভিন্ন এলাকায় নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। উত্তাল পশুর ও ভোলা নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে স্থানীয় প্রভাবশালীরা ডিসিআরের নামে চর দখল করে নিচ্ছে। সেই সুবাদে ভূমিহীনরা গড়ে তুলছে জনবসতি। এতে করে আয়তনে ছোট হয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রিয় সুন্দরবন।

সুন্দরবনের পরেই করুণ অবস্থায় আছে দেশের একমাত্র প্রবাল রাজ্য সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। দ্বীপটির অবস্থান বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্ব দিকে। আয়তন খুব বেশি নয়, মাত্র সাড়ে ৮ বর্গকিলোমিটার। জোয়ারের সময় আয়তন খানিকটা হ্রাস পেয়ে ৫ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়ায়। এ দ্বীপে রয়েছে প্রকৃতির অজস্র সম্পদ। এখানে রয়েছে বিলাসবহুল হোটেল-মোটেলসহ বেশ কিছু পাকা-সেমিপাকা দালান; যা ছিল না এক যুগ আগেও। এসব গড়তে গিয়েই সেন্ট মার্টিনের মাটি খোঁড়াখুঁড়ি করতে হচ্ছে। ফলে ভরা বর্ষায় দ্বীপ ভাঙনের কবলে পড়ে সংকুচিত হয়ে দ্বীপের আয়তন হ্রাস পাচ্ছে।

শুধু চলনবিল, সুন্দরবন, সেন্ট মার্টিন দ্বীপই নয়, দেশের অন্যান্য স্থানের ভূখণ্ড ও জলাশয়গুলোরও করুণ অবস্থা। প্রাকৃতিক সম্পদগুলো গলা টিপে হত্যার চেষ্টা করছে লোভী মানুষ। আবাসন, ফ্যাক্টরি ও দোকানপাট গড়ার মানসিকতায় নদী-নালা, খাল-বিল ভরাট করছে দ্রুত। এই থেকে রক্ষা পাচ্ছে না ফসলি জমিও। মানুষের অধিক লোভের কারণে জলাশয়ের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন আজ। ফলে ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে জলাশয়গুলো। যা দেখভালের কেউ নেই। এমতাবস্থায় কর্তৃপক্ষের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না আমাদের। প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার্থে যুব সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে, জনমত গড়ে তুলতে হবে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা বাড়াতে হবে। তবেই কিছুটা হলেও সুফল বয়ে আসবে। নচেৎ একদিন মানচিত্র থেকে জলাশয়গুলো হারিয়ে যাবে, যা উদ্ধার করাও কঠিন হবে পরবর্তী সময়ে। সুতরাং সময় থাকতে হুঁশিয়ার হতে হবে দেশবাসীকে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক কলামিস্ট