ছাত্রলীগে এরা কারা?

জামায়াতে ইসলামীর নেতা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী ছিলেন একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত। তার মৃত্যুতে সমবেদনা জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একের পর এক পোস্ট দিতে দেখা যায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের। টনক নড়ে সংগঠনটির নেতৃত্বের, একের পর এক বহিষ্কারের সিদ্ধান্তও আসতে থাকে। এই তালিকা ক্রমেই দীর্ঘ হওয়ায় ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের ভেতরে-বাইরে প্রশ্ন উঠছে, এরা কারা?

গত সোমবার (১৪ আগস্ট) রাত ৮টা ৪০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। এর পর থেকে মঙ্গলবার (২২ আগস্ট) পর্যন্ত তার মৃত্যুতে সমবেদনা বা সহানুভূতি জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ায় সারা দেশে আড়াই’শর বেশি পদধারী নেতাকে বহিষ্কার করেছে ছাত্রলীগ। প্রায় প্রতিদিনই এমন বহিষ্কারের তথ্য সামনে আসছে। যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগেও সাঈদীর মৃত্যুতে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ায় বহিষ্কারের ঘটনা ঘটেছে।

বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও কথা না বললেও আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতৃত্ব বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছে বলে নেতারাই জানিয়েছেন। তারা বলছেন, অসাম্প্রতিক চেতনায় বিশ্বাসী সংগঠনের পদধারী নেতাদের ক্ষেত্রে কেন এমন ঘটনা ঘটলো? এটি অনভিপ্রেত এবং বহিষ্কৃতরা সুযোগসন্ধানী বলে ছাত্রলীগের নেতারা দায় এড়ানোর চেষ্টা করলেও সংগঠনে তাদের প্রবেশের সুযোগ দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। এর দায় ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ নেতারা এড়াতে পারেন কিনা, সেই প্রশ্নও করছেন বিশ্লেষকরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ছাত্রলীগের ডজন খানেক নেতা বলেন, আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকায় মূল দলের পাশাপাশি বিভিন্ন অঙ্গ-সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনে অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেছে এবং ঘটছে। বিশেষ করে ছাত্রলীগে সুযোগসন্ধানীদের ঢুকে পড়ার ঘটনা তুলনামূলক বেশি। সরকারি দলে ঢুকে সুযোগ-সুবিধা পাওয়া এবং নিজেদের গোপন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অনুপ্রবেশ করছে তারা। এতে বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে, ছাত্রলীগকে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর পক্ষ নেওয়ার কোনও সুযোগ তার সংগঠনে নেই। যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে সহানুভূতি প্রকাশ করা কেউ ছাত্রলীগ করতে পারবে না। সব সাংগঠনিক ইউনিটকে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এ ধরনের সবাইকে বহিষ্কার করতে বলা হয়েছে। প্রয়োজনে সুবিধাবাদীদের চিহ্নিত করতে ছাত্রলীগে শুদ্ধি অভিযান চালানো হবে।

সাঈদীর মৃত্যুর ঘটনায় কেবল ছাত্রলীগই নয়, যুবলীগ এবং স্বেচ্ছাসেবক লীগেও বহিষ্কারের ঘটনা গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে। ফলে এসব সংগঠনের মূল দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতারা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন বলে জানান। তবে কেন এমন বিব্রতকর পরিস্থিতির সুষ্টি হলো, এর দায় কে নেবে এবং এদের কারা রিক্রট করলো— এমন প্রশ্নে বিষয়টি ‘স্পর্শ কাতর’ বলে নাম প্রকাশ করার কথা বলেছেন তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক শান্তনু মজুমদার বলেন, আমি মনে করি এখানে রিক্রুটমেন্টে গলদ রয়েছে। প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও ভয়াবহ গলদ রয়ে গেছে, তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। কোনও এক ফাঁকে কোনোভাবে সদস্য পদ নিয়ে দলে প্রবেশ করলাম, যার সঙ্গে কোনও আদর্শিক ঐক্য নেই। একটি দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে যে নীতি, আদর্শের মাধ্যমে যা গড়ে ওঠার বিষয় রয়েছে, সেটা যে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে হচ্ছে না। এটা তার বড় প্রমাণ বলে আমার মনে হয়।

তার মতে, একজন ইসলামিক চিন্তাবিদের পক্ষ নিলাম, এটা বলে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। প্রয়াত ওই ব্যক্তির সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে। একটি সুনির্দিষ্ট কর্মে তিনি সাজাপ্রাপ্ত এবং একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের অবস্থান ওই ব্যক্তির মতাদর্শের একেবারেই বিপরীত। সেখানে যখন আওয়ামী লীগের লোকজন সমবেদনা দেখাতে যান তখন কনট্রাডিকশনটা প্রকট করে তোলে।

শান্তনু মজুমদার বলছেন, এই উপমহাদেশে ধর্মের ব্যবহারের একটি জোয়ার বয়েছে। সেখানে অফিসিয়ালি অসাম্প্রদায়িক চেতনা একটি দল তার নতুন রিক্রুটদেরকে কতটা মুক্ত রাখতে পেয়েছে সেটা প্রশ্ন। এই স্টেটমেন্ট তাদের মূল সংগঠন আওয়ামী লীগের নীতি ও আদর্শের পরিপন্থি। এ ধরনের স্ট্যাটাস সংগঠনের শৃঙ্খলাবিরোধী, সেটা নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। যার প্রমাণ পাচ্ছি তাদের ব্যবস্থা নেওয়া দেখে।

ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত নেতাদের মধ্যে অনেকের ফেসবুক পোস্ট এখনও ঘুরছে নেট দুনিয়ায়। এসব পোস্টের অধিকাংশেই দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর জান্নাত কামনা করা হয়েছে। তবে কোনও কোনও পোস্টে তাকে ‘কোরআনের পাখি’ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী পিরোজপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জামায়াতে ইসলামীর সাবেক কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ডের আদেশ দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এর আগে ২০১০ সালের ২৯ জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার হন তিনি। ওই বছরের ২ আগস্ট মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়।

মানবতাবিরোধী অপরাধে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ায় পাবনায় ছাত্রলীগের আরও ১৭ জন নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে জেলা ছাত্রলীগ। গত রোববার (২০ আগস্ট) দুপুরে প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মিজানুর রহমান সবুজ তাদের সাময়িক বহিষ্কার করেন। এর আগে বৃহস্পতিবার (১৭ আগস্ট) এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ১১ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। একই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে চূড়ান্তভাবে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের জন্য সুপারিশ করা হয়।

সাময়িক বহিষ্কৃতরা হলেন- ফরিদপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সংগঠনিক সম্পাদক নাজিবুল ইসলাম নিয়ন, চাটমোহরের পার্শ্বডাঙ্গ ইউনিয়ন ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক লিটন খান, উপ-ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক রুবেল হোসেন, ভাঙ্গুড়া উপজেলার খান মরিচ ইউনিয়ন ছাত্রলীগের কর্মী রাকিবুল ইসলাম, ঈশ্বরদীর সাহাপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রুবেল হোসেন, ৮ নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জয় মালিথা, চাটমোহর ডিগ্রি কলেজ ছাত্রলীগের কর্মী প্রান্ত হোসেন, ঈশ্বরদী পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান, ঈশ্বরদী উপজেলা ছাত্রলীগের কর্মী মাহমুদুল হাসান শোয়েব, ফরিদপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক হাবিবুল্লাহ রহমান হাসিবুল, ফরিদপুর উপজেলার বিএল বাড়ি ইউনিয়ন ছাত্রলীগের কর্মী তরিকুল ইসলাম জীবন, বেড়া উপজেলা ছাত্রলীগের কর্মী হৃদয় রানা ও সবুজ সরদার, বেড়া উপজেলা ছাত্রলীগের কর্মী সুরুজ সরদার, নাজমুল ইসলাম, সাঁথিয়া উপজেলার নন্দনপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সুমন হোসাইন আকাশ, সাঁথিয়া উপজেলার গৌরীগ্রাম ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সহ সভাপতি হিমেল বিশ্বাস কাজল।

বহিষ্কার হওয়া ফরিদপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাজিবুল ইসলাম নিয়ন বলেন, আমি সাঈদীকে নিয়ে কোনো ধরনের পোস্ট করি নাই। আমার প্রতিপক্ষ সুপার এডিটিং করে জেলা ছাত্রলীগের কাছে ছবিটি পাঠিয়েছে। আমি সাঈদীকে নিয়ে পোস্ট করাতো দূরের কথা আমার উপজেলা ছাত্রলীগের যারা পোস্ট করেছিল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি। গত ১০ তারিখ থেকে বাবা অসুস্থ থাকায় তাকে নিয়ে ভাঙ্গুড়ার একটি হাসপাতালে ছিলাম। গতকাল বাবাকে নিয়ে বাড়িতে আসছি।

তিনি বলেন, আমি যদি দোষ করতাম তাহলে আমি মাথা পেতে নিতাম। আমি নিজেই ফেসবুকে পোস্ট করে পদত্যাগ করতাম। আমি এসব পোস্টের বিষয়ে মোটেও অবগত নয়। আসলে আমি রাজনৈতিক যড়যন্ত্রের শিকার। আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করতে এমন কাজ করা হয়েছে।

পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মিজানুর রহমান সবুজ বলেন, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী একজন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ছিলেন। একাত্তরে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। তার মৃত্যুতে ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী শোক জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেন। যেটা সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূত কাজ করেছে। বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মীদের একজন যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে শোক জানানো খুবই দুঃখজনক। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পরামর্শে প্রথমে ১১ জন এবং পরে ১৭ জনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। পাশাপাশি স্থায়ী বহিষ্কারের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।