শুক্রবার রাত ৯টা ৮ মিনিট। ঢাকার উদ্দেশে ট্রেন ছুটছে। হঠাৎ চলন্ত ট্রেনের জানালার কাচ ভেঙে এক টুকরা পাথর আঘাত হানে এক তরুণের মাথায়। কপাল ফেটে রক্ত ঝরতে থাকে। এ সময় ট্রেনে থাকা এক চিকিৎসক তাঁর চিকিৎসা দেন। সহযোগিতা করেন ট্রেনের টিকিট পরীক্ষকসহ (টিটি) পুলিশ সদস্যরা। এই চিকিৎসক সম্প্রতি ট্রেনের মধ্যে এক অন্তঃসত্ত্বার সন্তান প্রসবে সহায়তা করেছিলেন। তিনি ঢাকার ল্যাবএইড ক্যানসার হাসপাতালের চিকিৎসক মো. সানাউল্লাহ। শিশুটি অবশ্য মৃত ছিল।
আহত ওই তরুণের নাম রাকিব হাসান (২২)। তাঁর বাড়ি নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার ৫ নম্বর খাতা মধুপুর ইউনিয়নের মুশরুদ ধুলিয়া গ্রামে। তাঁর বাবার নাম মো. আবুল কালাম। তিনি ঢাকায় একটি কোম্পানিতে চাকরি করেন।
ডা. সানাউল্লাহ বলেন, ‘গ্রামের বাড়িতে ছুটি কাটানো শেষে শুক্রবার রাতে আন্তনগর নীলসাগর এক্সপ্রেস ট্রেনে সপরিবারে সৈয়দপুর থেকে ঢাকায় ফিরছিলাম। ট্রেনটি সৈয়দপুর স্টেশন ছাড়ার ঠিক ৪ মিনিট পর ৯টা ৮ মিনিটে এক যাত্রী চিৎকার দেন। পেছন ফিরেই দেখি তাঁর কপাল ও হাত রক্তে ভিজে গেছে। কাছে গিয়ে টিস্যু পেপার দিয়ে কপালটা চেপে ধরি। জানতে পারি, বাইরে থেকে ছোড়া পাথরের আঘাতে তাঁর কপালের মাঝখানে কেটে গেছে।’ আশপাশে ট্রেনের কোনো গার্ডকে না পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তিনি কল দেন টিটিই আমিরুল হক জাহেদীকে। এর মধ্যে ক্যাটারিংয়ের একজনকে বিষয়টি জানানো হলে, তিনি অন্য বগিতে দায়িত্বরত রেলওয়ে পুলিশকে জানান। পাঁচ মিনিটের মধ্যে মনিরুজ্জামান ও লিটন নামের দুজন পুলিশ সদস্য এলে তাঁদের দ্রুত ফাস্ট এইড বক্স আনতে বলা হয়।
কোনো ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত টিস্যু দিয়ে আহত রাকিবের মাথা চেপে ধরে থাকেন ডা. সানাউল্লাহ। ৯টা ২৫ মিনিটে ট্রেন পার্বতীপুর স্টেশনে পৌঁছার পর ৯টা ৩৬ মিনিটে গজ, তুলা, ভায়োডিন, ব্যথানাশক, ব্যান্ডেজ হাতে পান তিনি। সবকিছু হাতে পেয়ে ক্ষতস্থান ভালো করে পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দেন চিকিৎসক সানাউল্লাহ। এরপর পিপিআই ও ব্যথানাশক খাইয়ে কিছু ওষুধ লিখে দেন তিনি। তবে ক্ষত গুরুতর নয় বলে জানান ডা. সানাউল্লাহ।
টিটিই আমিরুল হক জাহেদী বলেন, ‘আমি ওই ট্রেনে ছিলাম না। তবে ডাক্তার সানাউল্লাহ ফোন করে ঘটনাটি জানিয়ে আহত তরুণের জন্য সহযোগিতা কামনা করেন। কিছু ওষুধপত্র ও ব্যান্ডেজ করার উপকরণ চান। আমি ওই ট্রেনে থাকা গাড়ির খাবার কর্মচারী মোবারক হোসেনকে দিয়ে সেগুলো পাঠিয়েছিলাম।’
ডা. সানাউল্লাহ বলেন, ‘আমি ট্রেন ভ্রমণ খুব উপভোগ করি। কিন্তু এবার ট্রেনে বাড়ি আসা ও যাওয়া দুটোতেই কষ্টদায়ক ভ্রমণের সাক্ষী হয়ে থাকলাম। ঢাকা থেকে বাড়ি যাওয়ার সময় এক অন্তঃসত্ত্বার চিকিৎসা আর বাড়ি থেকে ফেরার সময় এক আহত তরুণের চিকিৎসা দিতে পেরেছি—এটা ভেবে ভালো লাগছে। কিন্তু চাই না কেউ এভাবে অসুস্থ হোক, কষ্ট পাক।’
আহত রাকিব হাসান বলেন, ‘গত মঙ্গলবার (৫ সেপ্টেম্বর) বিকেলে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে যাই। সেখান থেকে ছুটি শেষে শুক্রবার রাতে ঢাকায় ফিরছিলাম। ট্রেনে ওঠার কিছুক্ষণ পর চলন্ত ট্রেনের জানালা লক্ষ্য করে ঢিল ছোড়ে দুর্বৃত্তরা। আমার কপালের মাঝখানে আঘাত লেগে কেটে যায়। পাশেই ছিলেন ডাক্তার সাহেব। তিনি যেভাবে আমাকে সাহস দিয়ে চিকিৎসা দিলেন আমি অভিভূত। তাঁর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসা জানাই। আমি সুস্থ আছি, ভালো আছি।’
ঢাকা থেকে নীলফামারীগামী আন্তনগর চিলাহাটি এক্সপ্রেস চলন্ত ট্রেনে গত রোববার (৩ সেপ্টেম্বর) রাতে এক অন্তঃসত্ত্বার মৃত সন্তান প্রসবে সহায়তা করেন ডা. সানাউল্লাহসহ ট্রেনে থাকা নার্সরা। ট্রেনের কামরা হয়ে উঠেছিল অপারেশন থিয়েটার। সবার সহযোগিতায় বেঁচে যান ওই গৃহবধূ।