দেশে ক্রমাগত কমছে সিএনজিচালিত গাড়ি ও রূপান্তরিত কারখানার সংখ্যা। এমন পরিস্থিতির জন্য গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি ও সংকট, হাইব্রিড গাড়ির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং বিদ্যুচ্চালিত যানবাহনে বাড়তি গুরুত্বকে দায়ি করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্যানুযায়ী দেশে সিএনজিচালিত যানবাহনের সংখ্যা ২ লাখ ৩৮ হাজার ৫৪০। এর মধ্যে অটোরিকশা রয়েছে ২ লাখ ১২ হাজার ৩৫৬টি। তিন বছরের ব্যবধানে দেশে সিএনজিচালিত গাড়ির সংখ্যা কমেছে অর্ধেকেরও বেশি। আরপিজিসিএল ও বিআরটিএ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, আমদানীকৃত জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো এবং পরিবহন খাত থেকে দূষণ রোধে দেশে সিএনজিচালিত যানবাহনের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। আর সরকার দেশজুড়ে সিএনজি ফিলিং স্টেশন স্থাপন ও যানবাহন সিএনজিতে রূপান্তরের জন্য কারখানা গড়ে তুলতে নীতি-প্রণোদনা দিয়ে সহায়তা করে। সরকারি নীতি-প্রণোদনা আর বেসরকারি বিনিয়োগে ভর করে পরিবহন খাতে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে সিএনজিচালিত গাড়ি। আমদানি ও রূপান্তরিত মিলে দেশে সিএনজিচালিত যানবাহনের সংখ্যা পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে যায়।
কিন্তু বর্তমানে সিএনজিচালিত পরিবহন খাতে দেখা যাচ্ছে বিপরীত চিত্র। প্রতিনিয়ত কমছে যানবাহনের সংখ্যা। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক রূপান্তর কারখানা। সূত্র জানায়, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিসিএল) তথ্যানুযায় ২০১৯ সালে দেশে সিএনজিচালিত যানবাহন ছিল ৫ লাখ ৩ হাজার ৮৬৪। বœ দেশে রূপান্তর করা যানবাহনের সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৭০ হাজার ২৩৯। সিএনজি ফুয়েল ব্যবস্থাসংবলিত আমদানি করা যানবাহন ছিল ৪০ হাজার ৩৮৩। সিএনজিচালিত থ্রি-হুইলারের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২। কিন্তু বর্তমানে সিএনজিচালিত গাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমেছে রূপান্তর কারখানার সংখ্যাও। কার্যক্রম গ্রহণ করতে না পারায় ১২১টি ‘সিএনজি কনভারশন ওয়ার্কশপ’-এর অনুমোদন বাতিল করেছে আরপিজিসিএল। বর্তমানে সক্রিয় রূপান্তর কারখানা রয়েছে ৫৯টি। তবে কার্যক্রম কমে যাওয়ায় এগুলোর একটি বড় অংশ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর্যায়ে চলে এসেছে।
সূত্র আরো জানায়, মূলত দেশে গত শতাব্দীর শেষ দশকে সিএনজিচালিত যানবাহনের প্রচলন শুরু হয়। সরকার ১৯৯০-৯৬ মেয়াদে বিশ্বব্যাংকের অঙ্গভুক্ত প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (আইডিএ) সহযোগিতায় ‘সিএনজি প্রকল্প’ নামে একটি উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে সরকার। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল যানবাহনে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহারের মাধ্যমে আমদানীকৃত জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো এবং পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখা। এ প্রকল্পের মাধ্যমে সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশন স্থাপন, পেট্রল ও ডিজেলচালিত যানবাহন সিএনজিতে রূপান্তরের জন্য ‘কিট’ ও সিলিন্ডার আমদানি, ভাসমান বার্জ মাউন্টেড সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশন স্থাপনসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়। এসব কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় দেশে সিএনজিচালিত যানবাহনের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ে।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সিএনজিচালিত যানবাহনের সংখ্যা ক্রমাগতভাবে কমে যাওয়ার জন্য গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি ও অপ্রাপ্যতাকে দায়ী করা হচ্ছে। এদিকে সিএনজি ফিলিং স্টেশন ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ফারহান নূর জানান, প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। বর্তমানে গ্যাস আর তেলের দামে খুব বেশি পার্থক্য নেই। আবার গ্যাস সংকটের কারণে ফিলিং স্টেশনগুলোয় সরবরাহ র্যাশনিং করা হচ্ছে। ফলে এমনও হয়েছে যে ২-৩ ঘণ্টা লাইন দিয়ে অপেক্ষার পর দেখা গেল চাপ কম থাকায় প্রয়োজনের অর্ধেক গ্যাসও পাওয়া যাচ্ছে না। র্যাশনিংয়ের ফলে রাত ১১টার আগে ফিলিং স্টেশনগুলো থেকে গ্যাস পাওয়া যায় না। এ সময়ের আগেই যদি গাড়ির গ্যাস ফুরিয়ে যায় তখন তো অলস বসে থাকতে হবে। একটা সময় দেশে বাস-ট্রাকের মতো বাণিজ্যিক যানবাহনগুলো সিএনজিতে চলত। কিন্তু গ্যাস সংগ্রহের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা এবং পর্যাপ্ত গ্যাস না পাওয়ার কারণে পরবর্তী সময়ে এসব যানবাহন আবার জ্বালানি তেলে ফিরে গেছে। তাছাড়া অনেক মালিকের অভিযোগ, সিএনজিতে রূপান্তরের পর ইঞ্জিনের আয়ু কমে যায়। তবে এটা নির্ভর করে রক্ষণাবেক্ষণের ওপর। একটা কথা মনে রাখতে হবে, এটা কিন্তু রূপান্তর করা যানবাহন। সিএনজিতে চলার উপযোগী করে কিন্তু উৎপাদক পর্যায়ে তৈরি হয়নি। মডিফায়েড সিস্টেম। এ সিস্টেমে গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে প্রথমে কিছুক্ষণ তেলে চালাতে হয়। এরপর গ্যাসে যেতে হয়। কিন্তু রূপান্তরের পর অনেকেই গাড়িতে আর তেল ব্যবহার করেন না। নিয়ম না মানার কারণেই ইঞ্জিনের ক্ষতি হয়।
অন্যদিকে সরকার দেশে জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর মোটরযানের বদলে বিদ্যুচ্চালিত যানবাহন ব্যবহার বৃদ্ধির নীতি গ্রহণ করেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের সড়ক পরিবহন খাতের অন্তত ৩০ শতাংশ গাড়ি বিদ্যুতে চালানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আর যানবাহনের জ্বালানি হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাস নীতি থেকে সরে এসে বিদ্যুৎকে প্রাধান্য দেয়ায় দেশে সিএনজিচালিত গাড়ির সংখ্যা কমছে। এ বিষয়ে আরপিজিসিএলের মহাব্যবস্থাপক (সিএনজি) খালেদা বেগম জানান, জ্বালানির প্রাপ্যতা ও সহজলভ্যতার ওপর নির্ভর করে মানুষ যানবাহন ব্যবহার করে। সিএনজিচালিত যানবাহন কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো কাজ করতে পারে। একইভাবে সরকারও নীতিগতভাবে যানবাহনের জ্বালানি হিসেবে তেল বা গ্যাসের বদলে বিদ্যুৎকে প্রাধান্য দিচ্ছে। অন্যদিকে গাড়ির জ্বালানি প্রযুক্তিও বদলে যাচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানির বদলে গুরুত্ব পাঁচ্ছে নবায়নযোগ্য জ্বালানি। আর সিএনজিচালিত যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য বর্তমানে আরপিজিএলের কোনো উদ্যোগ বা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নেই।