এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে যুগে ঢাকা, আজ উদ্বোধন

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, দেশের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই এক্সপ্রেসওয়ে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত এর প্রথম অংশের উদ্বোধন হচ্ছে আজ শনিবার (২ সেপ্টেম্বর)। পরদিন রবিবার (৩ সেপ্টেম্বর) থেকে যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে যোগাযোগের নতুন এই দিগন্ত।

উড়াল সড়কটি হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত যাবে। ঢাকা শহরের যানজট নিরসনসহ ভ্রমণে সময় ও ব্যয় সাশ্রয়ের লক্ষ্যে এই উড়াল সড়ক তৈরির উদ্যোগ নেয় সরকার। এর ফলে রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এই অবকাঠামো যানজটের শহর ঢাকায় যাতায়াতে যানজট কমাবে, সময় বাঁচাবে, ভোগান্তি কমবে, স্বস্তি মিলবে।

প্রকল্প কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত ১১ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ। এই রুটের উড়াল সড়ক, টোল প্লাজা এবং ওঠানামার র‌্যাম্পের নির্মাণ কাজ পুরোপুরি শেষ হয়েছে। উদ্বোধনকে ঘিরে সড়কটির দুই পাশে লাগানো হয়েছে রঙিন কাপড়ের পতাকা। চলছে ল্যাম্পপোস্টের টেস্টিংও। সবমিলিয়ে সাজসাজ রব। ফলে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এই রুটের যাত্রীরা এখন কেবল অবকাঠামোটির সুবিধা পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন।

দ্রুতগতির এই উড়াল সড়কে কাওলা, কুড়িল, মহাখালী, বনানী, তেজগাঁও ও ফার্মগেটে টোলপ্লাজা থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, এই সড়কে যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিসীমা হবে ৬০ কিলোমিটার। ফলে কাওলা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার যেতে বা আসতে সময় লাগবে ১২ থেকে ১৫ মিনিট। এই সড়ক ব্যবহারে নগরবাসীর যাতায়াতের সময় বাঁচবে, যানজটের ভোগান্তি কমবে, আসবে স্বস্তি।

তবে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বিমানবন্দর-ফার্মগেট অংশের ১৫টি ওঠানামার সিঁড়ির মধ্যে দুটির নির্মাণ কাজ এখনও বাকি আছে। ফলে সেই দুটি বাদে বাকি ১৩টি সিঁড়ি উদ্বোধনের সময় উন্মুক্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক।

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে চলাচলের জন্য যানবাহনকে চার শ্রেণিতে ভাগ করে টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ২১ আগস্ট সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট অংশের টোলহার জানায়। এতে সর্বনিম্ন টোল ৮০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, চার শ্রেণির যানবাহনের মধ্যে কার, ট্যাক্সি, জিপ, স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিক্যাল, মাইক্রোবাস (১৬ সিটের কম) এবং হালকা ট্রাকের (৩ টনের কম) টোল ফি (টাকা ও ভ্যাটসহ) নির্ধারণ করা হয়েছে ৮০ টাকা, সব ধরনের বাসের (১৬ সিট বা এর বেশি) ক্ষেত্রে ১৬০ টাকা, মাঝারি ধরনের ট্রাকের (৬ চাকা পর্যন্ত) ৩২০ টাকা, আর বড় ট্রাকের (৬ চাকার বেশি) ক্ষেত্রে ৪০০ টাকা টোল ফি নির্ধারণ করা হয়েছে।

বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট অংশ যানবাহনের জন্য উন্মুক্ত হওয়ার দিন থেকে এই টোলহার কার্যকর হবে এবং নির্ধারিত অংশের যেকোনও স্থানে ওঠানামার ক্ষেত্রে এই টোলহার প্রযোজ্য বলে জানানো হয় প্রজ্ঞাপনে।

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ওপর দিয়ে পথচারীদের চলাচল এবং বাইসাইকেল চলানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আপাতত মোটরসাইকেল-অটোরিকশার মতো তিন চাকার যানবাহন চলাচল করবে না বলে জানানো হয়েছে। গত ১৪ আগস্ট সেতু ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, এয়ারপোর্ট থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত প্রথম অংশ উদ্বোধনের পর এটি দিয়ে পথচারী ও বাইসাইকেল চলবে না। আর আপাতত মোটরসাইকেল চলাচল করবে না।

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি বাংলাদেশ সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। এটি পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ভিত্তিক দেশের বৃহত্তম প্রকল্প।

বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণে ২০১১ সালে সেতু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বেসরকারি অংশীদারদের চুক্তি হয়। প্রকল্পের বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের ২০১৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর সংশোধিত চুক্তি সই হয়।

২০১৪ সালের মধ্যে পুরো উড়াল সড়কের (১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার) কাজ শেষ করার পরিকল্পনা থাকলেও এক যুগ পর ২০২৩ সালে এসে বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত (১১ দশমিক ৫ কিলোমিটার) উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুত হয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির ৬০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। পুরো প্রকল্পের কাজ ২০২৪ সালের জুনে শেষ হবে বলে জানানো হয়েছে।

প্রকল্পটির ব্যয় শুরুতে ৩ হাজার ২১৬ কোটি টাকা ধরা হলেও কয়েক দফা তা বাড়িয়ে ১৩ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এ প্রকল্পে ইতালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি লিমিডেট ৫১ শতাংশ, চায়না শ্যানডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপ ৩৪ শতাংশ এবং সিনো হাইড্রো কোম্পানি লিমিটেডের ১৫ শতাংশের অংশীদার। কোম্পানিগুলো ২৫ বছর টোল আদায় করে সরকারের কাছে হস্তান্তর করবে।

সেতু কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রথম ধাপে বিমানবন্দরের দক্ষিণে কাওলা থেকে বনানী রেলস্টেশন পর্যন্ত ৭ দশমিক ৪৫ কিলোমিটারের নির্মাণ কাজ শেষ করা হয়। দ্বিতীয় ধাপে বনানী রেলস্টেশন থেকে মগবাজার রেলক্রসিং পর্যন্ত ৫ দশমিক ৮৫ কিলোমিটারের কাজ করা হয়েছে। এভাবে কুড়িল-বনানী-মহাখালী-তেজগাঁও-মগবাজার-কমলাপুর-সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত যাবে উড়াল সড়কটি। ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটারের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ওঠানামার জন্য ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ৩১টি র‌্যাম্প রয়েছে। ফলে র‌্যাম্পসহ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মোট দৈর্ঘ্য ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার সেতু বিভাগ আরও জানায়, প্রকল্পটি ঢাকা শহরের উত্তর-দক্ষিণ করিডোরের সড়কপথের ধারণক্ষমতা বাড়াবে। এ ছাড়া প্রকল্পটি ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হলে ঢাকা ইপিজেড ও উত্তরবঙ্গের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের যোগাযোগ সহজতর হবে। এতে ঢাকা শহরের যানজট নিরসনের পাশাপাশি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে।