উদ্বোধন ১০ অক্টোবর : পদ্মা সেতু দিয়ে পরীক্ষামূলক ট্রেন চলবে ৭ সেপ্টেম্বর

ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ৮২ কিলোমিটার নতুন ব্রডগেজ রেলপথ এখন ট্রেন চালানোর জন্য প্রস্তুত। তাই, পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে এই পথে পরীক্ষামূলক ট্রেন চালাতে যাচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।

আগামী ৭ সেপ্টেম্বর নতুন এ রেলপথ দিয়ে প্রথম ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন থেকে মাওয়া হয়ে ভাঙ্গা স্টেশনে যাবে ট্রেন। এরপরই আগামী ১০ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই রেলপথের উদ্বোধন করবেন। যদিও পুরো প্রকল্পে নির্মাণ হতে যাওয়া ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত রেলপথের দৈর্ঘ্য ১৭২ কিলোমিটার।

ঢাকা-পদ্মা সেতু-ভাঙ্গা রেলপথে পরীক্ষামূলক ট্রেন চালানোর জন্য ইতোমধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. কামরুল আহসান অনুমতি দিয়েছেন। আর ট্রেন চালানোর যাবতীয় ব্যবস্থা নিতে এক পত্রের মাধ্যমে রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক পূর্ব ও পশ্চিমকে অনুরোধ জানিয়েছে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক আফজাল হোসেন।

নতুন রেলপথে নতুন কোচ দিয়ে রেক তৈরি করে পরীক্ষামূলক ট্রেন চালানো হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। সেই মোতাবেক পত্রে বলা হয়েছে, টেস্ট রানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি নতুন একটি লোকমোটিভ (ইঞ্জিন), একটি পাওয়ার কার (ডব্লিউপিসি), শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ডাইনিং কার ও গার্ড ব্রেক (ডব্লিউজেডিআর), শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্লিপার কার (ডব্লিউজেসি), ২টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চেয়ার কার (ডব্লিউজেসিসি) এবং একটি শোভন চেয়ার কোচ (ডব্লিউইসি) ক্যারেজের প্রয়োজন হবে। এই ৭টি ক্যারেজ দিয়ে রেক তৈরি করে একটি ট্রেন ৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছানো প্রয়োজন। লোকমোটিভসহ ক্যারেজগুলোতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ক্রু এবং গার্ড নিয়ে ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছানোর জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো।

টেস্ট রানের ওই ট্রেনের যাত্রী হবেন রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন, রেলপথ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যরা এবং রেলেওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এদিকে পদ্মা সেতুতে পাথরবিহীন রেললাইন বসানোর কাজ শেষ হলে গত ৪ এপ্রিল ভাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন থেকে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে মাওয়া রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত পরীক্ষামূলক ট্রেন চালানো হয়েছিল। এবার ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ৮২ কিলোমিটার নতুন ব্রডগেজ রেলপথে পরীক্ষামূলক ট্রেন চালানো হবে।

প্রকল্প পরিচালক আফজাল হোসেন বলেছেন, ট্রেন চালাতে এই পথে গেন্ডারিয়া ও কেরানীগঞ্জ স্টেশনে কিছু টার্ন আউটের (এক রেলপথ থেকে আরেক রেলপথে ট্রেন যাওয়ার পথ) কাজ বাকি ছিল। সেগুলো গত ২৫ আগস্টের মধ্যে শেষ হয়েছে। বর্তমানে ঢাকা-ভাঙ্গা অংশ ট্রেন চলাচলের উপযোগী। আমরা ইন্সপেকশন কারের মাধ্যমে পুরো রেলপথটি পরিদর্শনও করেছি। আগামী ৭ সেপ্টেম্বর আমরা টেস্ট রান করবো। ওইদিন রেলপথ মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে। উদ্বোধনের আগে আমরা আরও টেস্ট রান চালাবো। গতকাল রোববার (৩ সেপ্টেম্বর) রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন জানিয়েছেন, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প আগামী ১০ অক্টোবর উদ্বোধনের জন্য প্রধানমন্ত্রী তারিখ দিয়েছেন। এর আগে আগামী ৭ সেপ্টেম্বর পরীক্ষামূলকভাবে একটি ট্রেন চালানো হবে। পদ্মা সেতু যখন সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয় তখন থেকে রেলওয়ে বাড়তি গুরুত্ব দেয় মাওয়া-ভাঙ্গা অংশের কাজে। এরপরও পুরো ঢাকা-যশোর অংশের কাজ সম্পূর্ণ করতে না পারায় সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে কর্তৃপক্ষ। পরে ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত ট্রেন চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এ বিষয়ে আফজাল হোসেন বলেন, শুরুতে ৩টি স্টেশনের (মাওয়া, পদ্মা (জাজিরা) ও শিবচর) সিগন্যাল ব্যবস্থা চালু করে ঢাকা-ভাঙ্গা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল উদ্বোধন করা হবে। এর বাইরে নিমতলা স্টেশনটিও চালুর চেষ্টা করা হচ্ছে। বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হবে উদ্বোধনের এক সপ্তাহ পরে। শুরুতে একটি ট্রেন নিয়মিত পরিচালনা করা হবে। প্রকল্প কার্যালয় থেকে ঢাকা-পদ্মা সেতু-রাজবাড়ী রুটে ট্রেন চালানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। অন্যদিকে রাজশাহী থেকে ঢাকা পর্যন্ত একটি ট্রেন চালানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া মধুমতি এক্সপ্রেস ট্রেনটি ভাঙ্গা পর্যন্ত আসে। এ ট্রেনটি ঢাকা পর্যন্ত আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, উদ্বোধনের তিন মাসের মধ্যে প্রধান প্রধান স্টেশনগুলো চালু হয়ে যাবে। ট্রেনের সংখ্যাও বাড়ানো হবে।

ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ডসহ প্রকল্পের মেয়াদ আরও দেড় বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। প্রকল্প কার্যালয় থেকে এ সম্পর্কিত একটি প্রস্তাব এরই মধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়েতে পাঠানো হয়েছে। তবে মেয়াদ বাড়লেও প্রকল্পটির ব্যয় বাড়ছে না বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক।

স্বল্পমেয়াদি ওই বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ২০৩০ সাল নাগাদ রেলপথটির ঢাকা-ভাঙ্গা অংশে প্রতিদিন ১৩ জোড়া ট্রেন চলবে। একইভাবে ভাঙ্গা-কাশিয়ানী অংশে প্রতিদিন ৭ জোড়া ও কাশিয়ানী-যশোর অংশে প্রতিদিন চলবে ৫ জোড়া ট্রেন। এ সময়ের মধ্যে ঢাকা-ভাঙ্গা অংশে বছরে ৪০ লাখ, ভাঙ্গা-কাশিয়ানী অংশে বছরে ১৭ লাখ ও কাশিয়ানী-যশোর অংশে বছরে সাড়ে ১৩ লাখ যাত্রী পরিবহন করা হবে। ‘ওয়ান ডিরেকশন’ বা একমুখী চলাচলের ওপর ভিত্তি করে এ প্রাক্কলনটি তৈরি করেছে চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ (সিআরইসি)। একইসঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ে ২০২৪ সালের জুন মাসের মধ্যে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত পুরো রেলপথটি চালুর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।

পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণের জন্য পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প ২০১৬ সালে অনুমোদন করে সরকার। প্রকল্পের আওতায় ১৭২ কিলোমিটার মূল রেলপথের বাইরে ৪৩ কিলোমিটার লুপ লাইন (স্টেশনের আগে-পরে বাড়তি লাইন) নির্মাণ করা হচ্ছে।

প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে ১০০ আধুনিক যাত্রীবাহী বগিও কেনা হয়েছে। এগুলো দিয়ে রেক সাজিয়ে নতুন ট্রেন চালু করা হবে। বর্তমানে পুরো প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি ৮২ শতাংশ। ২০২৪ সালের জুন মাসের মধ্যে ঢাকা-যশোর রুটে ট্রেন চালানোর টার্গেট রয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের।

পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে তৈরি নতুন ব্রডগেজ রেলপথে ১২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলতে পারবে। এ পথে থাকবে না কোনো রেলক্রসিং। কারণ, যেখানেই রেললাইন ও সড়ক মিলেছে, সেখানেই পাতালপথ তৈরি করা হচ্ছে। ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত মোট ২০টি স্টেশন থাকবে, যার মধ্যে ১৪টি নতুন এবং ৬টি আগে থেকেই রয়েছে। আগের স্টেশনগুলোরও আধুনিকায়ন করা হচ্ছে।

প্রকল্পটি যখন ২০১৬ সালে অনুমোদন করা হয়, তখন এর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৩৪ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের ২২ মে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করলে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। এই রেলপথ জিটুজির (সরকারের সঙ্গে সরকারের) ভিত্তিতে চীনের অর্থায়নে নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পের ঠিকাদারি কাজ করছে সিআরইসি। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে চীনের এক্সিম ব্যাংক ঋণ দিচ্ছে ২৬৬ কোটি ৭৯ লাখ ডলার। বাকি অর্থ ব্যয় করছে বাংলাদেশ সরকার।