মুচিপাড়ায় নেই চামড়ার উৎকট গন্ধ, নেই নোংরা পরিবেশ। সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চামড়ার উচ্ছিষ্টও আর চোখে পড়ে না। সব যেন ঝকঝকে তকতকে। বলা যায় পাবনার মুচিপাড়ার বাসিন্দারা একেবারেই বদলে গেছে। আধুনিকতায় নিত্য ছোঁয়ায় এ পরিবর্তন সূচিত হয়নি। পরিবর্তন এসেছে তাদের মনমানসিকতায়। এখন সন্ধ্যায় ঘরে ঘরে চোলাই মদের আসর নেই, নেই কোনো হৈ হুল্লোড়। সন্ধ্যাবাতি দেওয়ার পর পরই পাড়া থেকে ভেসে আসে কচিকণ্ঠের মধুর আওয়াজ ‘আমাদের দেশ তারে কতো ভালোবাসি/সবুজ ঘাসের বুকে শেফালির হাসি, মাঠে মাঠে চড়ে গরু নদী বয়ে যায়/ জেলে ভাই ধরে মাছ মেঘের ছায়ায়/রাখাল বাজায় বাঁশি কেটে যায় বেলা/চাষী ভাই করে চাষ কাজে নেই হেলা।
সোনার ফসল ফলে খেত ভরা ধান/সকলের মুখে হাসি, গান আর গান। মুচিপাড়ার ঘরে ঘরে এখন শিক্ষার আলো। তারা এখন লেখাপড়া শিখে এগিয়ে যেতে চায়। এ স্বপ্নের কথাই জানালেন মুচিপাড়ার সমাজপতি জেলা প্রশাসক অফিসের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী রতন দাস। তিনি জানালেন তাদের জীবনধারা পাল্টে যাচ্ছে। আমাদের নাতিপুতিরা আর বাপ দাদার পেশায় যেতে চায় না। আমাদের প্রজন্ম লেখাপড়া শিখে অন্য পেশায় যাচ্ছে এটা জীবদ্দশায় দেখতে পাবো তা কখনো ভাবতে পারিনি। সমাজের অবহেলিত মুচিরা দিনে দিনে এগিয়ে যাচ্ছে দেখে বেশ গর্ববোধ করছি।
ওদের নিয়ে স্বপ্ন দেখি একদিন ওরা এ মুচি জাতিকে সমাজে মর্যাদার আসনে দাঁড় করাবে। স্মৃতি হাতড়ে রতন দাস আরও বললেন, এক সময় সকালে ঘুম থেকে উঠেই বাপ দাদাদের আকাশের দিকে তাকিয়ে শকুন কিংবা কাকের আনাগোনা খুঁজতে দেখতাম। তারা মরা গরুর সন্ধানে অনেকদূর দৌড়ে গরুর চামড়া খুলে বাড়ি নিয়ে আসতেন। লবণে চামড়া শুকিয়ে তারা মহাজনের কাছে বিক্রি করতেন। মহাজনরা যা দিত তা দিয়ে চাল ডাল কিনে তারা বাড়ি ফিরতেন। যেদিন মরা গরু ছাগল জুটত না সেদিন ্একবেলা খেয়ে না খেয়ে কাটাতে হতো। কিন্তু আজ যেন তা বিস্মৃত ইতিহাস। আমাদের নাতি পুতিরা সকাল হলে আকাশের দিকে নয়, তাকায় ঘড়ির দিকে। সময় হলে ওরা প্যান্ট শার্ট পরে দৌড়ে যায় স্কুল কলেজে। তখন কি যে ভালো লাগে তা বলে বোঝাতে পারব না। রতন দাস প্রশ্ন করে বলেন, আপনার কি মনে হয় এটা মুচিপাড়া?
মুচিপাড়ায় চামড়ার উৎকট গন্ধ থাকবে না তা কি হয়? তিনি আবার বললেন এটা হয়েছে নাতি পুতিদের জন্যই। ওদের চোখ খুলে গেছে ওরা অন্যভাবে বাঁচতে চায়। তাই বলে মুচিপাড়ার ঐতিহ্য কিন্তু ধংস হচ্ছে না। এখনো অনেকে আধুনিকতাকে পুঁজি করে এ পেশাতে আঁকড়ে আছেন। পাবনা শহর থেকে আধা কিলোমিটার দূরের যুগীপাড়া পার হলেই মাঠপাড়ায় মুচিপাড়ার অবস্থান। এ পাড়ার নাম এখন দাসপাড়া নামেই বেশি পরিচিতি লাভ করেছে। এখানে ৬০ ঘর মুচি সম্প্রদায়ের বসবাস। পাড়ার অধিকাংশ পাকা আধা পাকা আর টিনের ঘরে বসবাস।
সম্প্রতি এক সকালে দাস পাড়ার গিয়ে দেখা যায় মন্দিরে দুর্গা প্রতিমা নির্মাণের তোড়জোড় চলছে।
পাড়ার বাসিন্দারা চাঁদা তুলে পাকা এ দুর্গা মন্দির নির্মাণ করেছেন। আর কয়েকদিন পরেই এখানে দুর্গোৎসবে মেতে উঠবেন এ পাড়ার বাসিন্দারা। এখানকার বাড়িঘর দেখেই বোঝা যায় তাদের জীবনে আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়া লেগেছে। বাড়ি বাড়ি টিভিতে ডিশ সংযোগের সঙ্গে নেট সুবিধাও চোখে পড়ল। সন্ধ্যা নামতেই ঘরে ঘরে ছেলেমেয়েরা পড়ার টেবিলে লেখাপড়ায় ব্যস্ত হয়ে ওঠার কথাও জানা গেল। পাড়ার সবাই এখন বেশ পরিবেশ সচেতন। চারদিকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ফুটফুটে পরিবেশ তা যেন জানান দিচ্ছে। দাসপাড়ায় ঘুরে মনে হয়েছে মহিলাদের মনমানসিকতায় যেন আমূল পরিবর্তন এসেছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিহিত মহিলারা এখন বেশ স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে উঠেছেন। গৃহিণী লক্ষ¥ী রানী রবি দাস জানালেন তারা অসুখে ঝাড়ফুঁক, পানিপড়া আর তাবিজ কবজে এখন বিশ^াস করেন না। যে কোনো স্বাস্থ্য সমস্যায় তারা পাবনা সদর হাসপাতাল ও পাবনা কমিউনিটি হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।
পৈত্রিক পেশা আঁকড়ে থাকা মুচিপাড়ার প্রদীপ রবী দাস, ক¤প রবি দাস, নিতাই রবিদাস, হরি রবি দাস, আনন্দ রবি দাস, খোকন রবি দাস, লক্ষ্মী রবি দাস, কুলদীপ রবি দাস,সঞ্জিত রবি দাস,বিক্রম রবি দাসের সঙ্গে কথা বললে তারা বেশ আস্থার সঙ্গেই জানালেন সন্তানরা এ পেশায় না আসুক এটাই তাদের একমাত্র চাওয়া। আর এ জন্যই তারা ফুটপাতে রোদ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে জুতা সেলাই করে ছেলে মেয়েদের পড়া লেখা শিখাচ্ছেন।
পাড়ার মেয়ে সরকারি অ্যাডওয়ার্ড কলেজের অনার্স শিক্ষার্থী রিংকী রবি দাসের সঙ্গে কথা বললে তিনি প্রশ্ন করেন মুচির ছেলেকে মুচি হতে হবে কেন? লেখা পড়া শিখে অন্য দশজনের মতো আমাদের মাথা তুলে দাঁড়াতে বাধা কোথায়? মান্ধাতা আমলের ধ্যান ধারণা থেকে বেরিয়ে লেখাপড়া শিখে মুচির ছেলেরা আজ সমাজে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে এটা আমাদের গর্ব।