পাবনার সুজানগর উপজেলার নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের মহব্বতপুর গ্রামের সদ্য এসএসসি পাস করা কিশোর রাসেল মন্ডল। নবম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে ক্রিকেটপাগল রাসেলকে টার্গেট করে বেটিং সাইটের এজেন্ট মোহাম্মদ আলী জীবন। টাকা ধার দিয়ে খুলে দেয় বেটিং সাইটের অ্যাকাউন্ট। গত দুই বছরে রাসেলকে প্রলুব্ধ করে কয়েক লাখ টাকার জুয়া খেলিয়েছে জীবন। বাজিতে হেরে রাসেলের মাথায় চাপে প্রায় দুই লাখ টাকার ঋণ। এরপর টাকা শোধে শুরু হয় মানসিক যন্ত্রণা। একপর্যায়ে জীবনের পরামর্শে রাসেল মায়ের গয়না চুরি করে। গত মে মাসে সুজানগর বাজারের একটি সোনার দোকানে গয়না বন্ধক রেখে চড়া সুদে ঋণ নেয় এক লাখ টাকা। মানসিক চাপ ও অনুশোচনায় সম্প্রতি মাকে গয়না চুরির কথা জানিয়ে দেয় রাসেল।
রাসেলের দেওয়া তথ্যের সূত্র ধরে সরেজমিন সুজানগর বাজারের ওই সোনার দোকানে গিয়ে তার মায়ের গয়নার সন্ধান মেলে। দোকানমালিক জানান, গত মে মাসে রাসেল ও জীবন উপজেলার উদয়পুর গ্রামের এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীর মাধ্যমে গয়না বন্ধক রেখে প্রতি মাসে সাত হাজার টাকা সুদের চুক্তিতে এক লাখ টাকা নিয়ে যায়।
তথ্যপ্রমাণসহ এজেন্ট জীবনের বিরুদ্ধে সুজানগর থানায় অভিযোগ করে রাসেলের পরিবার।
ঘটনার বিবরণ দিয়ে রাসেল জানায়, জীবনের প্ররোচনায় জুয়ায় জড়িয়ে নিজের ক্ষতির বিষয়টি বুঝতে পেরে এ পথ থেকে সরে আসার চেষ্টা করে সে। বাবা-মা তাকে গ্রাম থেকে ঢাকা পাঠিয়ে দিলেও জীবন তার পিছু ছাড়েনি। মানসিক চাপ সৃষ্টি করে আবার তাকে খেলতে বাধ্য করে। হেরে যাওয়ার পর টাকার জন্য চাপ দেয়। রাসেল বলেন, ‘আমাকে অপহরণের নাটক সাজিয়ে প্রবাসী বাবার কাছ থেকে টাকা আদায়, ঢাকার হাসপাতালে কিডনি বিক্রি করে টাকা জোগাড় করতে বললে আমি রাজি হইনি। একপর্যায়ে তাদের চাপে মায়ের গয়না চুরি করি। আমি এই ফাঁদ থেকে বের হতে চাই।’
রাসেলের মা রোজিনা খাতুন বলেন, ‘ছেলের কাছে সব জানতে পেরে আমি সুজানগর থানায় মোহাম্মদ আলী জীবনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করি। যারা আমার ছেলেকে বিপথে নিয়েছে, মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছে, আমি তার বিচার চাই।’
সম্প্রতি নাজিরগঞ্জ বাজারে এ বিষয়ে এজেন্ট জীবনের কাছে জানতে চাইলে তিনি অনলাইন জুয়ায় জড়িত নন বলে দাবি করেন। তবে তথ্যপ্রমাণ আছে জানালে তিনি দ্রুত সরে পড়েন।
স্থানীয়রা জানান, কেবল নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নেই বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রকাশ্যে সক্রিয় অন্তত ১০ জন অনলাইন জুয়ার এজেন্ট। এদের প্ররোচনায় জুয়ার ফাঁদে নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছেন অনেকেই।
অনুতপ্ত হয়ে কাজ ছেড়ে দেওয়া অনলাইন জুয়ার বেশ কয়েকজন এজেন্ট নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কেবল সুজানগরই নয়, পাবনার ১০টি থানার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে অনলাইন জুয়া। এতে সক্রিয় আছেন দুই শতাধিক এজেন্ট। বেটিং সাইটের এজেন্টরা প্রবাসী, অবস্থাপন্ন পরিবারের তরুণদের টার্গেট করে জুয়ার ফাঁদে ফেলে যুক্ত করছে নানা অপরাধে।
নাজিরগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী কেরামত আলী ব্যাপারী বলেন, ‘ব্যবসা দেখাশোনার জন্য ছোট ভাই রহমতকে দোকানে বসিয়েছিলাম। অনলাইন জুয়া এজেন্টদের খপ্পরে পড়ে গত দুই বছরে সে দোকানের ক্যাশ নষ্ট করার পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও থেকে চড়া সুদে প্রায় ২৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে। দিনে দিনে জমি বিক্রি করে তাদের দেনা শোধ করেছি। এখন আমি নিঃস্ব।’
একই গ্রামের রবিউল মোল্লা বলেন, ‘আমার বড় ভাই ইসা মোল্লাকে স্থানীয় মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট শীতল অনলাইন জুয়ার ফাঁদে ফেলে। খেলায় হেরে তার আয়ের সম্বল সিএনজিচালিত অটোরিকশা বিক্রি করে এখন বেকার হয়ে পড়েছেন। অথচ এজেন্টরা বহাল তবিয়তে আছে।’
জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সদস্য উৎপল মির্জা বলেন, ‘অনলাইন জুয়ায় তরুণ সমাজ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।’
পাবনার পুলিশ সুপার আবদুল আহাদ বলেন, ‘আমি সদ্য যোগদান করেছি। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’